স্বপ্ন দিয়ে শুরু
রফিক ছিল এক গরিব পরিবারের ছেলে। ছোট শহরের এক কোণায় বেড়ে ওঠা, কিন্তু চোখে ছিল বড় স্বপ্ন—দেশকে বদলাবে। কলেজে পড়াকালীন সে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়। বিশ্বাস ছিল, সৎ থেকে বদল আনা সম্ভব। সবাই যখন পদ আর ক্ষমতার জন্য দৌড়াচ্ছে, রফিক তখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় বিশ্বাসী।
কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন আসে। রফিক দাঁড়ায় সভাপতি পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সালমান, শহরের ধনী নেতার ছেলে। সালমানের পেছনে টাকা, পেশি আর দলে ভেতরের প্রভাব। অথচ রফিকের ছিল শুধু মানুষের ভালোবাসা আর কিছু নিষ্ঠাবান কর্মী।
নির্বাচনের আগে রফিকের ক্যাম্পাসে হামলা হয়। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়, কর্মীদের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু সে দমে না গিয়ে এক একটা ক্লাসরুমে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে। জনগণের মধ্যে আশার আলো জ্বলে ওঠে—হয়তো এবার পরিবর্তন সম্ভব।
নির্বাচনের দিন ভোরবেলা ছাত্রাবাসে আগুন লাগে। অনেকের কাগজপত্র, ইলেকশন সামগ্রী পুড়ে যায়। সন্দেহের তীর যায় সালমান গোষ্ঠীর দিকে, কিন্তু প্রমাণ নেই। তবুও, রফিক নির্বাচনে জিতে যায়। গণভবনে আমন্ত্রণ পায় না, কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের ভালোবাসা ছিল তার বিজয়ের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
কিন্তু এটাই ছিল কেবল শুরু।
যখন আদর্শের ফাটল ধরে
ছাত্র সংসদের সভাপতি হয়ে রফিক প্রথমেই ক্যাম্পাসে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করল। দুর্নীতিগ্রস্ত মেস কমিটি ভেঙে নতুন সৎ কমিটি গঠন করল, ছাত্রদের জন্য লাইব্রেরি ও ক্লাসরুমে নতুন চেয়ার-টেবিল এনে দিল, আর সবচেয়ে বড় কাজ—ক্যাম্পাসে সিন্ডিকেট ভাঙল।
কিন্তু এতকিছুর পরও অদৃশ্য এক চাপ চারদিক থেকে আসছিল। তার “বড় ভাই” হিসেবে পরিচিত এলাকার এমপি সাহেব একদিন ডেকে পাঠালেন।
— “তুই তো ভালো করছিস, রফিক। কিন্তু একটু বুঝে চলা শিখ। অত সরাসরি গেলে মেরে পড়বি।”
— “আমি তো অন্যায় কিছু করিনি ভাই। ছাত্রদের জন্য কাজ করছি।”
— “তোর কাজ আমাদের পার্টির লোকদের ক্ষতি করছে। আমরা টাকা ইনকাম করি ক্যাম্পাস সিন্ডিকেট থেকে। তোকে হুশিয়ার করে দিলাম।”
রফিক বুঝে গেল, এই রাজনীতিতে সৎ থাকা মানে একা হয়ে যাওয়া। ধীরে ধীরে তার পাশে থাকা সহকর্মীরা একে একে হারিয়ে যেতে লাগল। কেউ কেউ দলবদল করল, কেউ চাকরির আশায় এমপি সাহেবের পা ধরল।
ক্যাম্পাসে আরেকটা নতুন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলো। এবার রফিকের সামনে দাঁড়াল তার পুরনো সহচর—তানভীর। যে এক সময় রফিকের সঙ্গে স্লোগান দিত, এখন সে বড় নেতাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে।
তানভীর একদিন রফিককে চুপিচুপি বলল—
— “দোস্ত, ছেড়ে দে এসব। মন্ত্রীর লোকজন তোকে ছাড়বে না। পার্টির লোক হ, ভাইস চেয়ারম্যানের পোস্ট দিব। আবারও জিতবি।”
— “আর জিতেই বা কী করব? যদি নিজের মুখটা আয়নায় দেখতে না পারি?”
তানভীর হেসে উঠল। “আয়নায় মুখ দেখার রাজনীতি তো আর চলে না, রফিক। এখন চলে চুক্তির রাজনীতি।”
রফিক বুঝতে পারল—সে একটা ঘেরাটোপে আটকে গেছে। হঠাৎ রাতের বেলা তার নামে ধর্ষণচেষ্টার মিথ্যা অভিযোগে মামলা হয়। মিডিয়া মাতিয়ে তোলে, পার্টির নেতারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, এবং শেষমেশ তাকে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
সে রাতেই রফিক একা বসে জানালার ধারে সিগারেট ধরায়। তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। আদর্শ নিয়ে রাজনীতিতে আসা ছেলেটা জানে, রাজনীতি তাকে গিলে খেতে শুরু করেছে।
শেষে চক্রান্ত
রফিকের বিরুদ্ধে যখন মিথ্যা মামলা চলছিল, তখন চারদিক থেকে চাপ আসছিল—চুপ থাকো, মাফ চাও, রাজনীতি থেকে বিদায় নাও। অথচ এই ক্যাম্পাসেই সে হাজারো শিক্ষার্থীর আশার প্রতীক ছিল। কিন্তু এখন, কারও কোনো সাড়া নেই। সবাই যেন ভয়ে নীরব।
কারাগারে ২১ দিন কাটিয়ে রফিক জামিনে বেরিয়ে আসে। শহর বদলে গেছে। ক্যাম্পাসের দেয়ালে তার ছবির বদলে এখন তানভীরের পোস্টার। ছাত্রদের আন্দোলন থেমে গেছে। সবাই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। একমাত্র তার মা, আর কিছু পুরনো বন্ধু পাশে রয়ে গেছে।
একদিন রাতে, এক অন্ধকার গলিতে, রফিকের ওপর আরেকবার হামলা হয়। হাসপাতালে চোখ খুলে দেখে, একমাত্র ছোট ভাই শামীম পাশে বসে কাঁদছে।
— “ভাইয়া, আর রাজনীতি করিস না। এই রাজনীতি শুধু ছলনা।”
রফিক চুপ করে রইল। কিন্তু তার মাথার ভেতরে ঘুরছিল—এই কি তবে শেষ? এই কি তবে সেই ‘পরিবর্তন’-এর পরিণতি?
তবে…
এক সপ্তাহ পর, শহরের বড় এক মিডিয়া হাউজে একটি গোপন ভিডিও ফাঁস হয়। দেখা যায়—তানভীর, এমপি সাহেব এবং স্থানীয় এক নেতা বসে রফিকের বিরুদ্ধে সাজানো মামলার পরিকল্পনা করছে। ভিডিওটি রফিকের এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, শম্পা, গোপনে ধারণ করেছিল।
ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। মিডিয়ায় তোলপাড়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড়। ক্যাম্পাসে রফিকের সমর্থকরা আবার জেগে ওঠে।
চাপে পড়ে এমপি পদত্যাগ করে। তানভীর পালিয়ে যায়। মামলা খারিজ হয়। রফিক আবারো ক্যাম্পাসে ফিরে আসে—এইবার এক নতুন পরিচয়ে, এক অদম্য প্রতীক হিসেবে।
শেষ মুহূর্তে...
একটি গণসমাবেশে দাঁড়িয়ে রফিক বলে—
>“রাজনীতি নোংরা হতে পারে, কিন্তু মানুষ যদি না লড়ে, তবে সেই নোংরা জিতে যাবে। আমি হারতে পারি, কিন্তু মাথা নত করব না। যারা স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য আমার লড়াই চলবেই।”


