সেদিন বিকেলটা ছিল অন্যরকম। আকাশের রঙটা ঠিক যেমন হয় ভোরবেলা ঘুম ভাঙার আগ মুহূর্তে— অর্ধেক আলো, অর্ধেক অন্ধকার। দূরে কালো মেঘ জমে উঠছিল, যেন পুরোনো কোনো অভিমান আবার ফিরে আসছে। শহরের রাস্তা তখনো শুকনো, কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ— মাটির, কাঁচা, তবুও নরম এক ভালোবাসার মতো।
রিদয় ছাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাসা থেকে বেরোলো। আজ তাকে দেখা করতে হবে মিতার সঙ্গে— প্রায় তিন মাস পর। শেষ দেখা হয়েছিল বসন্তের দুপুরে, যখন রোদটা নরম ছিল আর সম্পর্কটা অনেক উষ্ণ। তারপর এক অদ্ভুত অভিমান এসে সবকিছু ঠান্ডা করে দিয়েছিল। ফোন বন্ধ, মেসেজ দেখা হয়নি, আর কোনো কথা নয়।
কিন্তু আজ মিতা নিজেই বলেছে,
“তুই যদি সময় পাইস, বিকেল পাঁচটার দিকে পুরান ক্যাফেটায় আয়।”
রিদয়ের বুকের মধ্যে হালকা কম্পন হচ্ছিল। তিন মাসের দূরত্ব এক বিকেলে মিটে যাবে?
বৃষ্টি নামতে শুরু করল হালকা করে। প্রথমে টুপটাপ, তারপর একটু জোরে। রাস্তার বাতিগুলো ম্লান হয়ে গেল, দোকানের শাটার আধখোলা, চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
ক্যাফেটা পুরনো। দেয়ালে দাগ পড়া, কাঠের চেয়ারগুলো একটু নড়বড়ে, তবুও সেখানে একটা আলাদা উষ্ণতা আছে। রিদয় ঢুকেই তাকাল জানালার পাশে— ঠিক যেখানটায় তারা প্রথম একসাথে বসেছিল। সেখানে মিতা বসে আছে। চোখে আগের মতোই কালো কাজল, কিন্তু মুখটা যেন একটু ক্লান্ত।
রিদয় এগিয়ে গেল।
— “অনেক দিন পর।”
— “হ্যাঁ, অনেকটা দিন।”
দু’জনেই হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে মিষ্টি ছিল না, ছিল চাপা কষ্ট।
বাইরে তখন বৃষ্টি বাড়ছে। কাচে টুপটাপ শব্দ পড়ছে, কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। সময় যেন থমকে গেছে।
রিদয় কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,
— “তুই কেমন আছিস?”
— “ভালো থাকার চেষ্টা করি। তুই?”
— “একই রকম।”
নীরবতা। শুধু বৃষ্টি কথা বলছে।
মিতা ধীরে বলল,
— “জানিস, অনেকবার ফোন ধরতে চেয়েছি। কিন্তু ভয় করতাম— তুই হয়তো রাগ করবি।”
রিদয় চোখ নামিয়ে বলল,
— “আমি ভাবতাম তুই আমার কথা ভুলে গেছিস।”
— “ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ তুই নস।”
বৃষ্টির শব্দটা তখন যেন একটু কোমল হয়ে এলো।
মিতা বলল,
— “সেদিন তুই বলেছিলি, আমার চুপ করে থাকা মানে ‘না’। আমি তো শুধু ভয় পেয়েছিলাম। তোর মতো কাউকে হারানোর ভয়।”
রিদয় হেসে ফেলল, একটু কষ্টের হাসি।
— “তাহলে আজ দেখা করতে এলি কেন?”
— “বৃষ্টি নামবে ভেবেছিলাম। তুই আসবি জানতাম।”
দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ।
জানালার কাচ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, যেন তাদের মনের ভেতরের সব কথাগুলো নিচে নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মিতা কফির কাপটা ঘুরিয়ে বলল,
— “তুই জানিস, বৃষ্টির দিনে সব সময় তোর কথাই মনে পড়ে। মনে হয়, যদি তুই পাশে থাকতিস, তাহলে বৃষ্টিটা আরও সুন্দর লাগত।”
রিদয় জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
— “আজ তো আমি আছি।”
বৃষ্টি তখন আরও জোরে পড়ছে। ক্যাফের ভেতর মৃদু আলো, কেউ তাড়াহুড়ো করছে না। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা এই একটা বিকেলেই থেমে থাকুক।
রিদয় ধীরে হাত বাড়িয়ে মিতার আঙুলে ছোঁয়া দিল। মিতা চমকে গেলেও হাতটা সরায়নি।
— “তুই জানিস, আমি এখনো তোর সঙ্গে থাকা ভাবি।”
মিতা মৃদু হাসল,
— “আমি ভাবা বন্ধ করতে পারিনি।”
বাইরে তখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। ক্যাফের ভেতর আলো নিভে গেল মুহূর্তের জন্য। সেই অন্ধকারে তাদের মুখ একদম কাছে এলো। কেউ কিছু বলল না— শুধু শ্বাসের শব্দ, আর বৃষ্টির তীব্র ছন্দ।
বাতি আবার জ্বলে উঠল। দু’জনেই একটু লজ্জায় মাথা নিচু করল।
মিতা বলল,
— “এই বৃষ্টিটা কি আবার শুরু হতে পারে, রিদয়?”
রিদয় উত্তর দিল,
— “বৃষ্টি তো থামেই না, শুধু একটু বিরতি নেয়।”
হালকা হাসির সাথে সময় কেটে গেল। ক্যাফের ঘড়িতে ছয়টা বাজে। বৃষ্টি তখনও থামেনি, বরং আরও ঘন হয়ে নেমেছে।
মিতা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট ছাতা বের করল।
— “একটা ছাতা, দু’জনেরই চলবে?”
রিদয় বলল,
— “চেষ্টা করা যাক।”
বাইরে বের হতেই ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগল। ছাতার নিচে জায়গা কম, দু’জনের কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। রাস্তার লাইটগুলো ঝাপসা, চারপাশে কুয়াশা আর বৃষ্টির পর্দা।
মিতা ধীরে বলল,
— “এই মুহূর্তটা যেন থেমে যায়।”
রিদয় তার দিকে তাকিয়ে বলল,
রাস্তার পানি পেরিয়ে তারা হাঁটছে। মাঝে মাঝে গাড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে পানি, তবুও তারা হাসছে। এমন হাসি, যা অনেক দিন পর ফিরে এসেছে।
একটা ছোট গলিতে পৌঁছে মিতা থামল।
— “আমার বাসা এইদিকে।”
— “জানি।”
— “তুই এবার যাবি?”
রিদয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “বৃষ্টি থামলে যাব।”
কিছু সময় তারা দাঁড়িয়ে থাকল নীরবে। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের গন্ধ, সবকিছু মিলেমিশে যেন একটা গান বাজছে।
মিতা বলল,
— “তুই যদি আবার হারিয়ে যাস, আমি রাগ করব।”
রিদয় বলল,
— “হারিয়ে যাব না, যদি তুই ডেকে রাখিস।”
মিতা মৃদু হাসল। সেই হাসিতে ছিল নতুন করে শুরু করার ইঙ্গিত।
বৃষ্টি তখন ধীরে ধীরে থেমে আসছে। আকাশের কোণে একটা হালকা আলো— হয়তো সন্ধ্যার আগের রোদ, অথবা নতুন ভালোবাসার প্রথম সিগন্যাল।
রিদয় পেছনে ফিরল, মিতা তখনো ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে।
চোখে বৃষ্টির ফোঁটা, ঠোঁটে একটুখানি হাসি।
রিদয়ের মনে হলো— এই বৃষ্টি, এই বিকেল, এই মুহূর্ত— সবই যেন তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কবিতা।


