ঢাকার মিরপুরে একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকে আরিফ। বয়স তেইশ, সদ্য গ্র্যাজুয়েট, এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা—এই হচ্ছে তার দৈনন্দিন সময়সূচি। ছুটির দিনে ঘুমিয়ে পড়ে দুপুর পর্যন্ত, আবার সোমবার এলেই শুরু হয় সেই একই রুটিন।
আরিফের মা প্রায়ই ফোন করেন—
“বাবা, তোদের বাসায় রান্নাবান্না ঠিকঠাক হচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ মা, কাজের মেয়েটা সময়মতো আসে।”
“তুই একটু সময় পেলেই বাড়ি আয়, তোকে অনেক দিন দেখি না।”
আরিফ শুধু হাসে, বলে—
“সময়ই তো নাই মা… অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়…”
এই "সময় নেই" যেন একটা জাদু বাক্স হয়ে গেছে তার জীবনে। সময় নেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার, সময় নেই বই পড়ার, সময় নেই নিজের জন্য একটু হাঁটাহাঁটি করার। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যেন ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে—একটানা, অবিরাম।
একদিন শনিবার সকালে, হঠাৎ করেই অফিস থেকে ফোন আসে না। কোনো কাজ নেই, কোনো মিটিং নেই। এটা যেন এক অচেনা অবকাশ। আরিফ অবাক হয়, এমন নিরবতা কবে পেয়েছে শেষবার?
সে বেরিয়ে পড়ে হাঁটতে, কাছের পার্কে যায়। রিকশাও নেয় না। রোদ মাথায় নিয়েই হাঁটে। পার্কে বসে দেখে কিছু বাচ্চা খেলছে, একজন বৃদ্ধ চুপচাপ বসে আছেন, পাশের বেঞ্চে এক দম্পতি নিজেদের মধ্যে হাসছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, এমন পার্কে সে আগে এসেছিল, ক্লাস নাইন-টেনে থাকতে—বন্ধুদের সঙ্গে। এখন তারা সবাই ব্যস্ত, কেউ প্রবাসে, কেউ সংসারে, কেউ বা তার মতো অফিসে ডুবে।
আরিফ মোবাইলটা বের করে, বন্ধুর নাম্বারে ফোন দেয়।
“কিরে, আজ পার্কে যাবি? ভাবছি আড্ডা দিই।”
ওপাশ থেকে জবাব আসে, “ভাই, আজ তো টাইম নাই... পরে কোন এক দিন!”
আরিফ হাসে। ব্যস্ততার চাকার নিচে সবারই গল্প এক।
সেদিন রাতে সে মাকে ফোন দেয়—
“মা, আগামী শুক্রবার আসবো বাড়ি।”
ওপাশে নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ।
সময় সবকিছুর মাঝে থাকে, শুধু একটু থামতে হয়, একটু মন দিয়ে দেখতে হয়—জীবন কতটা পাল্টে যাচ্ছে, আর আমরা কী হারাচ্ছি এই ব্যস্ততার দৌড়ে।