কয়েদি নম্বার-৩১২

দুপুরটা যেন আগুন গিলে ফেলছে শহরটাকে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলো খালি হয়ে পড়েছে, কেবল ক’জন রিকশাওয়ালা ছায়া খুঁজে বসে আছে। এমনই এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে আলমগীর, সাদা শার্ট, গলায় রুমাল ঝুলছে, হাতে একটা রেজিস্টার খাতা।

এই শহরে আলমগীরকে সবাই চেনে। তাকে দেখে দোকানদাররা মাথা নিচু করে, কারণ সে আসে টাকা তুলতে — নাম তার “চাঁদা”।

"বসের জন্য লাগবে, কাজ চলে না টাকা ছাড়া," – এমন করেই সে শুরু করেছিল। প্রথমে ছোট দোকান, পরে বাসস্ট্যান্ড, তারপর প্যাকিং কারখানা — কোথায় নয়!

টাকা না দিলে কী হতো?

দোকান ভাঙা, পুলিশের ভয় দেখানো, ছেলেদের দিয়ে হুমকি — এসব ছিল তার অস্ত্র। একসময় এই শহরে তার নাম শুনলেই মানুষ দরজা বন্ধ করত।


---


একদিন সন্ধ্যায়, একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকেছিল আলমগীর। দোকানদার বৃদ্ধ লোকটা, চোখে চশমা, বলেছিল,
“বাবা, আজ মাফ করো। মেয়ের ওষুধ কিনতেই কষ্ট হচ্ছে।”

আলমগীর দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলল —
“পরের সপ্তাহে দিবা। খবরদার, টাকা যেন ঠিক থাকে।”

কিন্তু সে জানত, এই টাকা গায়ের জোরে নেওয়া। কোনো রসিদ নেই, কোনো নিয়ম নেই।
তবু সে চালিয়ে গেল, কারণ এখন পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই।


--


চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে সে বাইক কিনল, ব্র্যান্ডেড জামা, একসময় শহরের রাজনীতিতেও ঢুকল।
কিন্তু মানুষ তাকে ভয় পায়, সম্মান করে না।

একদিন রাতে, যখন সে বাসায় ফিরছিল, রাস্তার মোড়ে ছেলেরা বলছিল,
“আলমগীর ভাইয়েরও সময় শেষ হয়ে আসছে। থানার নতুন ওসি নাকি কাউকে ছাড়বে না।”

সেই রাতেই প্রথমবার, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে ভয় দেখেছিল আলমগীর।
হাতে গোনা বন্ধু, মিথ্যা দম্ভ আর অভিশপ্ত টাকা — এগুলোই কি তার জীবন?


---


সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজি ছিল এক সিমেন্ট ডিপোর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়া।
বিষয়টা গোপনে ভিডিও করে থানায় জমা দিয়েছিল এক কলেজছাত্র, যার বাবার দোকানে একসময় আলমগীর চাঁদা তুলেছিল।

এক ভোরে, ঘুম ভাঙার আগেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করল তাকে।
সংবাদপত্রে হেডলাইন হলো —
"আলমগীর, শহরের কুখ্যাত চাঁদাবাজ অবশেষে ধরা পড়ল"


জেলে যাওয়ার আগে একমাত্র ছোট ভাইটাকে চিঠি লিখেছিল—

> "জোর করে নেওয়া টাকা কিছুদিন সুখ দিতে পারে, কিন্তু শান্তি কখনোই দেয় না।আমি হারিয়েছি নিজের সম্মান, নিজের মুখ।চাঁদা নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, এখন চিরকাল আরেকজনের খাবার থালায় নাম লেখা থাকবে — কয়েদি নম্বর ৩১২।"




---


চাঁদাবাজি হলো সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট আত্মম্ভরিতা — যেখানে ভয় দিয়ে টাকা নেওয়া হয়, অথচ একদিন সেই ভয়ই তার নিজের গলায় দড়ি হয়ে ফিরে আসে।

আলমগীরদের মতো মানুষ হয়তো শুরুতে জিতে যায়,
কিন্তু শেষটা সবসময় পরাজয় — নীরব, লজ্জাকর, একাকী।

আপনার মূল্যবান মতামত প্রদান করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন

 বিজ্ঞাপন 



https://rkmri.co/ST55TMpTEIM0/