আজ ৩১ সে অক্টোবর, ২৯৪৬ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নীলফামারী-২ আসনের সংসদ,বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।আজকে তিনি ৭১ পেরিয়ে ৭২ বয়সে পা রাখলেন।রুপমের ব্লগের পক্ষথেকে জনপ্রিয়,অভিনেতা,রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূরকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশির দশকের কথা, বিটিভিতে তখন ধারাবাহিক একটা নাটক প্রচারিত হয়, ‘কোথাও কেউ নেই’ সেই নাটকের নাম। শেষ পর্বে নায়ক বাকেরের ফাঁসি হবার সমূহ সম্ভাবনা, তখনই ভোজবাজীর মতো কিছু ঘটনা ঘটলো। সেই নায়কের ফাঁসির রায় বাতিলের দাবীতে রাজপথে নামলো জনতা, ঢাকার রাস্তায় মিছিল বেরুলো, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রায়, মানি না মানবো না!’ ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে!’ নাটকের পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের বাড়িতে ঢিল পড়লো, হুমকি দিয়ে বেনামী চিঠি লেখা হলো তাকে। নাটকে বাকেরের বিরুদ্ধে যিনি সাক্ষী দিয়েছিলেন, বদি চরিত্রে অভিনয় করা সেই আবদুল কাদের থানায় জিদি করলেন পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে।
অবস্থা বেগতিক দেখে নাটকের প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খান হুমায়ূন আহমেদকে বললেন, কোনভাবে স্ক্রীপ্টটা পাল্টানো যায় কিনা, বাকেরের ফাঁসির ব্যপারটা না রাখলেই ভালো হয়। হুমায়ূন আহমেদও একরোখা মানুষ, লেখকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা তিনি মেনে নিতে পারবেন না। মূল স্ক্রীপ্টেই নাটক প্রচারিত হলো বিটিভিতে, ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই সেদিন সন্ধ্যা থেকে কারেন্ট নেই, পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ তার শহীদুল্লাহ হলের বাসভবন ছেড়েছেন এর খানিক আগে।
তখন তো সবার বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না, যেসব বাড়িতে টিভি ছিল, সেখানেই লোকজন জড়ো হয়ে নাটক বা খবর দেখতো। নাটক শেষ হবার পরে অদ্ভুত একটা দৃশ্যের অবতারণা হলো ঘরে ঘরে। বাড়ির মহিলারা কাঁদছেন, পুরুষেরা কেউ কান্না লুকনোর চেষ্টা করছেন, কেউবা পরিচালকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। বাচ্চাকাচ্চারা কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে হতবাক হয়ে বড়দের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! পরদিন দেশের বেশকিছু অঞ্চলে ‘বাকের ভাই’য়ের গায়েবানা জানাজা হয়েছিল, গরু জবাই করে কুলখানি অনুষ্ঠান পালনের খবরও শোনা গিয়েছিল। সেসবের কতখানি সত্যি কতখানি মিথ্যে কে জানে!
তবে হ্যাঁ, একটা বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, সেটা ‘বাকের ভাই’ –এর তুমুল জনপ্রিয়তার। যে মানুষটা একটা কল্পিত চরিত্র দিয়ে লাখো কোটি দর্শকের হৃদয়ে ভালোবাসার আসন গড়ে নিয়েছিলেন, তার নাম আসাদুজ্জামান নূর। আশির দশকের সেই সময়টায় নাকি বাকের ভাইয়ের জনপ্রিয়তার নীচে তার নামটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল! এরপরেও তিনি নাটক করেছেন, সিনেমায় অভিনয় করেছেন, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। অথচ লোকে এখনও আসাদুজ্জামান নূরের নাম শুনলে ‘বাকের ভাই’কে একবার স্মরণ করেই, যেন দুটো সমার্থক শব্দ!
বাংলাদেশের মানচিত্রের একদম ওপরের দিকে তাকালে নীলফামারী জেলাটার অবস্থান চোখে পড়বে। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এই জেলাটার অবস্থান এখন রংপুর বিভাগে, আগে ছিল বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের অংশ। ঢাকা থেকে বাসে চড়ে যেতেও প্রায় অর্ধেকটা দিন লেগে যায় এখনও। সেই নীলফামারীতেই এই মানুষটার বেড়ে ওঠা। ১৯৪৬ সাল, ভারত থেকে তখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, দেশভাগের আন্দোলনে টালমাটাল পুরো উপমহাদেশ। সেই অস্থির সময়ে জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে।
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন একদম কিশোর বয়স থেকেই, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে শেখেননি কখনও। বামপন্থী রাজনীতি করতেন, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬২’র আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তিনি। দেশকে স্বাধীন করেই ফিরেছেন। পরের বছর যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে, একই সময়ে শুরু করেছিলেন থিয়েটারও, ‘নাগরিক’ নাট্যদলের সদস্য হয়েছিলেন সেবছর। দুটো একসঙ্গে চালানো যাবে না ভেবে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন পরে, পুরোটা মনযোগ ঢেলে দিয়েছিলেন অভিনয়ে।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে মঞ্চ মাতিয়েছেন অনেকগুলো বছর। আপাদমস্তক থিয়েটারের মানুষ তিনি, অভিনয়ের পাঠ সেখানেই, তাকে এমন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে নাগরিকের অবদান অনেকখানি। এই দলের জন্যে বিদেশী নাটক থেকে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নামের একটা নাটক অনুবাদ করেছিলেন তিনি, সেটার প্রদর্শনী এখনও হয়। টেলিভিশনের পর্দায় হূমায়ুন আহমেদের সঙ্গে তার জুটিটা তো কিংবদন্তীতুল্য হয়ে আছে। অয়োময়, এইসব দিনরাত্রি, আজ রবিবার, সবুজ ছায়া- একটার পর একটা নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, অর্জন করেছেন জনপ্রিয়তা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছেন ওই এক ‘কোথাও কেউ নেই’ দিয়ে।
ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা…’, হাতে চেইন, ঠোঁটে সিগারেট, মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাকের ভাই তখন তরুণদের কাছে আইডল, তরুণীদের দীর্ঘশ্বাসের আরেকটা নাম। একটা নাটক দিয়ে এতখানি জনপ্রিয়তা বোধহয় পুরো বিশ্বেই আর কেউ অর্জন করতে পারেননি কখনও। এইসব দিনরাত্রিতে তিনি রফিক, অয়োময়ে ছোট মির্জা, বহুব্রীহিতে আনিস; চরিত্র পাল্টেছে, তার দুর্দান্ত অভিনয় থেকে বঞ্চিত হয়নি দর্শক। পর্দায় তিনি আক্ষরিক অর্থেই মানুষকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, অভিনয় দিয়ে দর্শকের চোখের জল বের করে আনাটা যেকোন অভিনেতার জন্যেই বেশ দুঃসাধ্য একটা ব্যপার, সেই কাজটাই কি অবলীলায় করে গেছেন আসাদুজ্জামান নূর!
জুটির বেলায় তিনি ছিলেন জলের মতো। সুবর্ণা মুস্তফার সঙ্গে তার রোমান্স যেমন মানুষ দুহাতে গ্রহণ করেছে, একইভাবে বয়সে অনেক ছোট বিপাশা হায়াতের সঙ্গেও তিনি দারুণ সাবলীল। আগুণের পরশমণিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা, যার বেঁচে থাকার অপেক্ষায়, স্বাধীন দেশের সূর্যটা দেখার অপেক্ষায় দর্শক তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকে। আবার চন্দ্রকথায় তিনি অত্যাচারী এক জমিদার, ক্ষমতা চলে গেলেও যিনি সেই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চান, দূর্বলের ওপর অত্যাচার চালান। সেখানে তাকে দেখে রাগ হয়, ঘৃণা জমে।
তার দাড়ি রহস্য নিয়ে অনেকের আগ্রহ আছে, কেন তিনি দাড়ি রেখেছিলেন। তার উত্তরটা সোজাসাপ্টা- রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে চাকুরী করার সময় তাকে খুব ভোরে উঠতে হতো। তখন শেভ করার সময় পেতেন না দিনে। বেশ খানিকটা বড় হয়ে যাবার পরে নিজের কাছে ভালো লাগলো, খানিকটা মায়াও লাগলো কেটে ফেলতে। একারণেই দাড়ি রাখা। দাড়ি নিয়ে একটা মজার ঘটনাও আছে। জহির রায়হানের উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’ অবলম্বনে নাটক তৈরি হচ্ছে তখন, আসাদুজ্জামান নূরের বিপরীতে আছেন সুবর্না মুস্তফা। সুবর্না তখন একেবারেই তরুণী, তার বিপরীতে আসাদুজ্জামান নূরকে খানিকটা বয়স্ক লাগতে পারে ভেবে নাটকের প্রযোজক একদিন বললেন- ‘নূরভাই, আপনি দাড়িগুলো কেটে ফেলেন প্লিজ।’ পরদিন শুটিঙে এসে সুবর্ণা আসাদুজ্জামান নূরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলেন না, মিতা চৌধুরীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নূরকে তিনি দেখেছেন কিনা। শেভ করে আসা আসাদুজ্জামান নূর তখন মিতা চৌধুরীর পাশেই বসে আছেন, সুবর্ণা তাকে চিনতেই পারেননি!
একটা সময় হুমায়ূন আহমেদ তাকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য লিখতেন, চরিত্র সাজাতেন তাকে ঘিরে। হুমায়ূন আহমেদের ভাবনার জগতটা এভাবে আর কোন অভিনেতা দখল করতে পেরেছিলেন বলে জানা নেই। সেই আসাদুজ্জামান নূর ১৯৯৮ সালে আওয়ামীলীগে যোগ দেয়ার পর অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ধীরে ধীরে। রাজনীতি ব্যপারটা তার মাথায় গেঁথে ছিল। অভিনয়কে ভালোবেসে সেখান থেকে একটা সময় দূরে সরে এলেও, সেই জায়গাটায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা তার বরাবরই ছিল। আশির দশকের শেষ সময়টায় তার তুমুল জনপ্রিয়তা, তখন তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে, বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন স্বৈরাচারের পতন চাই! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালত গঠিত হয়েছিল, সেখানেও তার অংশগ্রহণ ছিল।
২০০১ সালে প্রথমবার তিনি সাংসদ পদে লড়াই করেন আওয়ামীলীগের হয়ে। সেবার নির্বাচনে দলটার ভরাডুবি হলেও নতুন প্রার্থী হয়েও ঠিকই নিজের আসনে জয়লাভ করেন আসাদুজ্জামান নূর। তার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তায় কখনও ভাটা পড়েনি। পরের দুই জাতীয় নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, ২০১৩ সাল থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রচলিত রাজনীতিবিদদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা তিনি, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে পছন্দ করেন না কখনও। তার কাছে রাজনীতি মানে দায়িত্ব পালন করা, মানুষের জন্যে কাজ করা।
বয়সের ঘড়ি বাহাত্তরে দাঁড়িয়েছে। এখনও আসাদুজ্জামান নূর বাইশের টগবগে তরুণের মতো পরিশ্রম করেন। অভিনয়টা তার রক্তে মিশে গেছে, তাই তো নুহাশ হূমায়ুনের ‘হোটেল অ্যালবাট্রসে’ অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে না করেননি। বয়সের ছাপটা তার দেহে পড়েনি, অভিনয়েও না। হূমায়ুনপুত্রের প্রথম নাটকটায় দেখার মতো কিছু থেকে থাকলে সেটা আসাদুজ্জামান নূরের দুর্দান্ত অভিনয়ই।
বাংলা নাটকের সেই সোনালী দিনগুলো হারিয়ে গেছে তিনি অভিনয় থেকে সরে যাওয়ার পরেই। একজন আসাদুজ্জামান নূর হয়তো আর কখনও আসবেন না, একজন বাকের ভাইয়ের জন্মও আর হবে না। বাকের ভাই চরিত্রটাকে ঘিরে সেই ঘটনাগুলো বাংলা নাটকের তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষী হয়েই থেকে যাবে আজীবন।
★সূত্রঃ ইন্টারনেট
শুভ জন্মদিন
উত্তরমুছুন