কুকি-চিনঃএকটি বিচ্ছিন্ন জাতিগোষ্ঠী

স্বাধীনতার আগে থেকেই পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এটা ওটা নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকতো।যা স্বাধীনতার এতো বছর পার হলেও মিটমাট হয়নি।পাহাড়িদের মধ্যে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে অনেক লোক হতাহত হয়েছে।বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি বেশি আলোচিত ঘটনা।যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত।এ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের অবসানের আশা প্রকাশ করা হয়।শান্তি চুক্তি যা বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এরমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণ ও উপজাতিদের অধিকারও স্বীকৃতি প্রদান করে এবং শান্তিবাহিনী ও সরকারের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা বিদ্রোহের অবসান ঘটায় বলে মনে করা হয়।কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের এত বছর পরেও চুক্তিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং উপজাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিস্থিতি দ্বন্দ্ব এবং তার একটি জটিল সংমিশ্রণ।পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ছোট ছোট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে।পাশাপাশি প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়।সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে চরম দারিদ্রতা,সম্পদের ঘাটতি ও নিম্নমানের সাক্ষরতা লক্ষ্য করা যায়।স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে,তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৯৭ সালের 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি।এ চুক্তির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।বিগত কয়েক বছর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের  বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।যার ফলে সহিংসতার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে।পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগত রাজনৈতিক দল থাকলেও তাদের মধ্যে আদর্শিক মতবিরোধ নেই বললেই চলে।তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য দলগুলো আন্তঃসংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।পাহাড়ি সব দলেরই  নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র এবং আধুনিক অনেক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত।এমনকি কারো কারো নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে।অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপন আদায় এবং চাঁদাবাজি অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় ও চাঁদাবাজি এদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।এখানে ১০ শতাংশ হারিয়ে ঠিকাদারদের চাঁদা দিতে হয়।শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সংঘাতে প্রায় ১২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চল নতুন করে অস্থির হয়ে উঠছে।এখানে একের পর এক বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে হত্যা পাল্টা হত্যাকাণ্ড চলছে।পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
 কয়েক বছর আগে কুকি-চিনি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (KNF)নামের একটি সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সাথে একটি পৃথক রাষ্ট্র দাবি করে ও সশস্ত্র আন্দোলনের হুমকি দেয়।সে সময় বিষয়টি নিয়ে সারা তোলপাড় হলেও,বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা বিস্মিত হয়নি।১৯৯৭ সালের চুক্তির সময় পাহাড়ে প্রচুর ছোট ছোট গ্রুপ থাকলেও কুকি-চিন এর মত গোষ্টিগুলো গুরুত্ব পাইনি।তখন তাদের দাবিদাওয়া পরিষ্কার ছিল না।অনেকটা হঠাৎ করেই কুকি-চিনের মত গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে।গত কয়েকদিন থেকে কুকি-চিনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভ খবর প্রচারিত হচ্ছে।তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে কুকি-চিন সম্পর্কে জানার অবতারণা হয়েছে।কুকি-চিন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে।পাহাড়ের নির্দিষ্ট কোন একটি জাতি বা গোষ্ঠী নয়।মূলত পাহাড়ে ৫০ টির উপরে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী নিয়ে কুকি-চিন গঠন করা হয়। 
লুসাই,বম,পাংখো,জো,থাডো,রেংমিটস,ম্রো প্রভুতি কুকিগোষ্ঠীর  অন্তর্ভুক্ত।ব্রিটিশ উপনিবেশিক নীতির কারণে সার পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কুকি-চীন গোষ্ঠী।এরা বিভিন্ন কুকি ভাষায় কথা বলে।এদের মধ্যে খ্রিস্টান, সর্বপ্রাণবাদী,এমনকি ইসলাম ধর্মের অনুসারীও রয়েছে।কুকি জনগোষ্ঠী ঘন জঙ্গল বেষ্টিত অঞ্চলে বসবাস করে।এরা আবার কঠোর পরিশ্রমী হয়ে থাকে,এরা কৃষিকাজ করে ও গৃহপালিত পশু পালন করে। প্রতিষ্ঠা কালীন সময় ২০১৭ সালে বম জনগণের দুই হাজার কর্মি নিয়ে ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উপর বৈষম্যের অভিযোগ তুলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা করেন।২০০৮ সালে নাথান কুকিচিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট(KNDO) নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন।২০১৬ সালে তিনি কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স(KNN) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন।২০১৭ সালে কেএনডি এর নাম পরিবর্তন করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট রাখা হয়।নাথান বম এর পুরো নাম নাথান লনচেও বাম।স্থানীয়রা জানান রুমা উপজেলার হেডের পাড়ার বাসিন্দা বাথান বম তার বয়স আনুমানিক প্রায় ৪২ বছর।নাথান বোম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।নাথান বম এক সন্তানের জনক।তার স্ত্রী স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক পাশাপাশি পরিকল্পনা কর্মী হিসেবে কাজ করেন।নাথান ছাত্র জীবন থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।প্রথমে যুক্ত ছিলেন সন্তু নারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে।ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র হিসেবে শিখেছিলেন ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ।নাথান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে সুযোগ পাননি,পরে বিশেষ কোটায় ভাস্কর্য বিভাগে ভর্তি হন।পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরে মহাজন পাড়া এলাকায় লারম স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মান করেন।২০০০ সালে ভাস্কর্যটি উদ্বোধনের পর শিল্পী হিসেবে খ্যাতিবাড়ে।বম বিষয়ে লেখালেখির পাশাপাশি সে সময় হিল আর্টিস্ট গ্রপেও যুক্ত ছিলেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতি গোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে 'দ্য বমজৌ' নামের একটি বই প্রকাশ করেন।এছাড়াও গবেষণামূলক আরো পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়।এই কারণে নাথান লেখক হিসেবেও পরিচিত, প্রথমে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন(KNDO) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৬ সালে সশস্ত্র একটি গ্রুপ তৈরি করেন।পরে কেএনডিও এর বদলে কুকি-চিন দিয়ে কার্যক্রম চালান।২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।বিভিন্ন কারণে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।সে সময় তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।তবে মনোনয়ন পত্র বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।এরপর ভারতের মনিপুর ও বার্মার চীন রাজ্যের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।(KNDO) প্রথম ব্যাচে সংগঠনের শতাধিক সদস্যকে মনিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠান।এরপর ১০০ সদস্যকে মনিপুরে বার্মার কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হয়। তাদের সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি(KNF)।
কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি,কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি,জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দ আল-শারক্কিয়া কেএনএফ এর মিত্র হিসেবে পরিচিত।এরা বাংলাদেশ সরকার,বাংলাদেশ সেনাবাহিনী,র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়।বাংলাদেশী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য থেকে অস্ত্র পায়।২০২৩ সালে জামাআতুল আনসার ফিল হিন্তাল শারক্কিয়া অস্ত্রের জন্য কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টেকে ১.৭ মিলিয়ন দিয়েছে। ২০২৩ সালের ১ই জুন বান্দরবনে কেএনএফ এর পুতেরেখা বোমা বিস্ফোরণ এক সেনা সদস্য নিহত হয়।এরপর ১৬ই জুলাই থেকে সুজন চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ২০২৪ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কে এন এফ এর সদস্যরা চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় উহ্লাচিং মার্মাকে গুলি করে আহত অবস্থায় ফেলে যায়।১৮ই ফেব্রুয়ারি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর হুমকির মুখে বান্দরবানের থানচি,রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।এরপর ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল রাতে কে এন এফ এর কিছু সদস্য রুমায় অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা লুট করে।এর পরের দিন দুপুরে থানচিতে কৃষি ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের দুটি শাখায় ডাকাতির চেষ্টা চালায়।ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ছাড়াও সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কে অপহরণ আনসার ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৪ টি অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা।পরবর্তীতে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপনের বিনিময়ে ম্যানেজারকে মুক্তি দেওয়া হয়।

মূলত ব্যাংক ডাকাতি ও ম্যানেজারের অপহরণ ও মুক্তির বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এফ এর সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে।খোঁজাখুঁজির পর কে এন এফ এর একটি ফেসবুক পেজ দেখতে পাই।পেজটি যখন খুজে পাই।তখন রীতিমত আমি ভরকে যাই সে সময় পেজটির ফলোয়ার সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার। টাসকি খেয়ে গেলাম এই ছোট্ট একটা সংগঠন কিভাবে গোটা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের মানুষকে তোলপাড় করে দিচ্ছে।এই পেজের মাধ্যমে আরো জানতে পারি তারা তাদের এলাকায় মাঝে মাঝে যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।এর প্রধান নাকি আবার
 জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়! কেএনএফ এর সাথে নাকি সরকারি উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দুই দুইবার বৈঠক পর্যন্ত হয়েছে!ভাবা যায় বিষয়গুলো।
            (অসমাপ্ত)

আপনার মূল্যবান মতামত প্রদান করুন

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم