২১ ফেব্রুয়ারী একটি চেতনার মৃত্যু

ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ১৬০০ সালে ব্রিটিশরা এই দেশে প্রবেশ করে। কলঙ্কিত পলাশী যুদ্ধের নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ১৭৫৭ সালে উপমহাদেশের শাসনভার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ ও কৌশলে ব্রিটিশরা  প্রায় ২০০ বছর ভারতীয় উপমহাদেশ  শাসন করে। এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৪৭ সাল,১৪ ও ১৫ ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এর মাধ্যমেই ব্রিটিশদের দূ'শ বছরের শাসন ও শোষণের অবসান ঘটে। পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশ অংশ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রের।জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের প্রতি ব্রিটিশদের চেয়েও খারাপ আচরণ করতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে প্রথম আঘাত আসে ভাষা নিয়ে।১৯৪৮ সাল পাকিস্তান ঘোষণা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যেখানে পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি সে সময়ের যুবসমাজ। ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতায় এবং পাকিস্তানের ধারাবাহিক চাপের ফলে ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা আরও অনেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে  নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। এরপরই পাকিস্তান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে একটি অদ্বিতীয় ইতিহাস রচিত হয়। পৃথিবীতে আর কোথাও ভাষার জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি। বাঙ্গালীদের নিজস্ব একটি ইতিহাস রচিত হয়।এরপর ২০০০ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে।এতে আর একবার গর্বে বুক ভরে যায়।


ছোটবেলা থেকে এসব গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি।আর এই ইতিহাস বুকে ধারণ করে বড় হয়েছি, নিজেদের গৌরবের উজ্জ্বল ইতিহাসের জন্য বুকটা ভরে যেত, বায়ান্ন, একাত্তরের কথা শুনলেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠত। দেশকে ভালোবেসে কত কিছু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু কোন কিছুতেই সফল হতে পারেনি। দেশের জন্য কিছু করার জন্য তরুণ বয়সেই,"তরুণ সংঘ"  নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি।আর এই সংগঠনের প্রথম কাজ ছিল এলাকার নিরক্ষর মানুষের মাঝে অক্ষর জ্ঞান ও সাক্ষরতা প্রদান। এজন্য একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু এলাকার কিছু প্রভাবশালী মানুষের বিরোধিতার কারণে তা আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরেও মাথা উঁচু করে বলতে চাই একজন হলেও আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সাক্ষরতা পেয়েছেন। যিনি এখন ছোট হলেও ব্যবসা করছে,আগে যেখানে পায়ে টানা ভ্যান গাড়ি চালক ছিলেন।এর পরের কাজটি ছিল ভাষা শহিদের সম্মানে শহিদ মিনার স্থাপন করা।এর জন্য স্থান নির্ধারণ করতেই হিমশিম খেতে হয়।  ২০১১ সালে এলাকায় আমার প্রচেষ্টায় প্রথম শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়।সে বছরেই এলাকার বিরোধপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সফল ভাবে  শহিদ দিবস পালিত হয়। এলাকাবাসীর সমর্থন ছাড়া কোন কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এলাকাবাসীর সহযোগিতা তো দূরের কথা অসহযোগিতায় করেছে বারংবার।এলাকার একজন শিক্ষকের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে এলাকার প্রথম শহিদ মিনারটি নিশ্চিহ্ন করা হয়। 

২০১৩ সালে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ  গঠন করি। এরপর পেটের দায়ে রাজধানীতে পাড়ি দিলে সবকিছুতেই ভাটা পড়ে যায়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারি এসব শুনলেই যেখানে গয়ে কাঁটা দিত, সেখানে অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে গেছে। আগের অনুভূতিগুলো  আর কাজ করে না।রাজধানীতে থাকলেও একের অধিক স্মৃতিসৌধে যাওয়া হয়নি। বইমেলাতে তো যাওয়ায় হয়নি! একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটি থাকলেও প্রাণের উৎসব  বই মেলায় যাওয়া হয় না, যেখানে অনেক স্বপ্ন ছিল সারাদিন স্মৃতিসৌধে  আর সারা মাস বই মেলাতে পড়ে থাকবো।

মূলত বর্তমানে বাংলার মানুষের আচার-আচরণে  আমার চেতনাগুলো মরে যাচ্ছে।আমার পরে আমার উত্তরসুরিরা আবার শহিদ মিনার স্থাপন করে। প্রথম দুই একবার আমার খোঁজ খবর নিলেও এখন আর কেউ খোঁজ খবর কেউ নেয় না। সেদিন দেখলাম যে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে আমার শহিদ মিনারটি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল,সেই শিক্ষকেই এবারের শহিদ দিবসের প্রধান অতিথি! তিনি নাকি এবার চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ঘটা করে শহিদ দিবস পালন করলেও জেলায় যে একজন ভাষা যোদ্ধার বাড়ি আছে তা ক'জনের বা জানে?আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, কিন্তু ন্যায় ও সত্যের কথা বলতে ভয় পাই। বিভিন্ন দিবস আসলেই দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মুখে কথার খই ফোটে। এবার একুশে ফেব্রুয়ারি দেখলাম একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মূখেফেনা তুলছে।আমার কথা হচ্ছে উনি ভাষা দিবস সম্পর্কে কি জানেন? বাংলাদেশের যা অর্জন তাঁর কোনটিতেই এই প্রভাবশালীদের অবদান নেই। বাংলার অর্জনে খেটে-খাওয়া,দিনমজুর ও সাধারণ জনগণের অবদান সবার উপরে।তাই সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরতে হবে। তা নাহলে চেতনা বলতে শুধু শব্দটি থেকে যাবে। যেটা একটা ব্যবসায়িক হাতিয়ার  হিসাবে ব্যবহার হবে। 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন