প্রসঙ্গ কথাঃ
"চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং -এর অবদান। " একটি তাত্ত্বিক বিষয়। যার মধ্যে ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করার খুব বেশি সুযোগ নেই। চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ইতিহাসে মাও সেতুং একটি অনন্য নাম। তার হাত ধরেই চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মাও সেতুং এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বর্তমানেও চীনে বিদ্যমান। মূলত তার সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সংস্কার করে বর্তমানে চীনে সমাজতন্ত্র টিকে আছে। আমার এই "চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং -এর অবদান।" নামক গবেষণাপত্রটি অতি সহজ সরল ও সাবলিল ভাষায় স্পষ্ট ভাবে রচনা করা হয়েছে।
"চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং -এর অবদান। " একটি তাত্ত্বিক বিষয়। যার মধ্যে ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করার খুব বেশি সুযোগ নেই। চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ইতিহাসে মাও সেতুং একটি অনন্য নাম। তার হাত ধরেই চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মাও সেতুং এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বর্তমানেও চীনে বিদ্যমান। মূলত তার সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সংস্কার করে বর্তমানে চীনে সমাজতন্ত্র টিকে আছে। আমার এই "চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং -এর অবদান।" নামক গবেষণাপত্রটি অতি সহজ সরল ও সাবলিল ভাষায় স্পষ্ট ভাবে রচনা করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ঃ-
ভূমিকা ও মাও সেতুং-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ভূমিকাঃ মাও সেতুং ( Mao-Tse-Tung) ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক ও রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে মার্কস এঙ্গেলস লেনিনের পরেই মাও সেতুং এক মহান ব্যক্তিত্ব ও কীর্তিমান সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিগনিত। জার্মানি দখলদার শক্তি ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চীনের জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লব সংগঠনের মূর্ত প্রতিক ছিলেন মাও সেতূ্ুং। ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সেখানে মার্কসবাদের সার্থক রুপায়ন ঘটে। মার্কসীয় আদর্শে উজ্জীবিত মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চীন বিপ্লবের মধ্যদিয়ে গণচীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও মাও নিজস্ব চিন্তাধারা প্রয়োগ ও সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এক্ষেত্রে মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বা রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
পরিচয়ঃ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বা চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং -এর অবদান আলেচনার পূর্বে তাঁর সংক্ষওপ্ত পরিচয় তুলে ধরা অবশ্যক। মাও সেতুং চীনের হুনান প্রদেশে শাংতান জেলার শাউশাংচু গ্রামের কৃষক পরিবারে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাও সেতুঙ্গের বাবার নাম ছিল মাও জেন শেং (শুন সেন),শুন সেন দরিদ্র কৃষক হলেও কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করে জমিজমা ক্রয় করে অবস্থার উন্নতি করেন। এবং কাঁচামালের ব্যবসা করে রীতিমত মধ্যবিত্ত গৃহস্ত হয়ে ওঠেন। মাওয়ের মা ছিলেন তংশিয়াতো গ্রামের বেন পরিবারের মেয়ে। তিনি ছিলেন দয়ালু। মাও বৌদ্ধ ধর্মের ভক্ত ছিলেন। মাওয়ের বয়স যখন মাত্র সাত তখন থেকে খেত-খামারের কাজে লেগে যান।
শিক্ষা জীবনঃ ১৯০১ সালে আট বছর বয়সে মাও গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। এবং তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ঐ পাঠশালায় লেখাপড়া করেন। ১৯০৬ সালে মাওয়ের গ্রমের পড়াশোনা শেষ হয়। এর পর তাঁর বাবা তাকে সৈন্যদলে ভর্তি করানোকে লাভজনক মনে করেন। তার আগে মাওয়ের সঙ্গে এগারো - বারো বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। পর্বতীকালে মাও সেতুং এ বিষয়ে লিখেছেন, "এটা ছিল একে বারে নাম মাত্র বিয়ে। আমি কখনোই তার সঙ্গে বসবসা করিনি এবং তাকে আমার স্ত্রী বলেও মনে করিনি। "
রাজনীতিঃ১৯১১ সালে মাও সেতুং হুনানের রাজধানী চাংশায় উচ্চ শিক্ষার্থে গমন করেন। তখন সেখানে জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে মঞ্চু সম্রাটের বিরুদ্ধে জনগণের বিপ্লব চলছিলো। এ বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এ বিপ্লবের দ্বারা মাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এবং নিজেও তাতে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থগারে চাকরি লাভের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু চীনা জনগোষ্ঠির মুক্তির সংগ্রাম তাকে বেশি দিন চাকরিতে থাকতে দেয়নি। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে মাও সেতুং হুনানের অত্যাচারী শাসনকর্তার বিরুদ্ধে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে মাও সেতুং এতে যোগদান করেন এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং তিনি চীনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪৯ হতে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মাও সেতুং চীনের আর্থ- সামাজিক সাংস্কৃতিক পূর্নগঠনে এক অভাবনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়ে অমর হয়ে আছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ-
সমাজতন্ত্রঃ
সমাজতন্ত্র বা সমাজবাদ (ইংরেজি : Socialism) হচ্ছে এমন একটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনীতির একটি সমবায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, এছাড়াও একই সাথে এটি একটি রাজনৈতিক মতবাদ ও আন্দোলন যার লক্ষ্য হচ্ছে এই ধরনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।অর্থাৎ এটি এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে একটি দেশের কলকারখানা, খনি, জমি ইত্যাদি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। 'সোসালিজম' শব্দটি ১৮২৭ সালে ইংল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) কো-অপারেটিভ ম্যাগাজিনে প্রথম ব্যবহার করেন।
সমাজতন্ত্র হল সাম্যবাদী সমাজের প্রথম পর্যায়। উৎপাদনের উপায়ে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা হলো এর অর্থনৈতিক ভিত্তি। সমাজতন্ত্র উৎখাত ঘটায় ব্যক্তিগত মালিকানার এবং মানুষে মানুষে শোষণের বিলোপ ঘটায় অর্থনৈতিক সঙ্কটের ও বেকারির, উন্মুক্ত করে উৎপাদনী শক্তির পরিকল্পিত বিকাশ ও উৎপাদন সম্পর্কের পূর্ণতর রূপদানের প্রান্তর। সমাজতন্ত্রের আমলে সামাজিক উৎপাদনের লক্ষ্য_ জনগণের স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি ও সমাজের প্রতিটি লোকের সার্বিক বিকাশ। সমাজতন্ত্রের মুলনীতি হলো প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেকে গ্রহণ করবে তার প্রয়োজন অনু্যায়ী। সমাজতন্ত্র দুই ধরনেরঃ কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছিলো ১৯১৭ সালে।
বৈশিষ্টসমূহ
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান বৈশিষ্ট হল কলকারখানা, জমি এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ সবই সামাজিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন থাকে।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় আয় সুষমভাবে বন্টিত হয়। এই অর্থব্যবস্থায় জাতীয় আয় বন্টনের মূলনীতি হলঃ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। এভাবে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি মুনফার কোন সুযোগ থাকে না।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যানের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। অর্থাৎ সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উতপাদন, বন্টন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষনের কোন সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান সমান সুবিধা ভোগ করে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক প্রয়োজনীয়তা যেমনঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সকল খাতে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উন্নয়ন করা হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা মাফিক সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাই এই অর্থব্যবস্থায় বেকারত্বহীনতা ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় বিধায় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত সঙ্কট দেখা দেয় না।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দ্রব্যের মূল্য পুঁজিবাদের ন্যয় চাহিদা ও যোগানের ঘাত প্রতিঘাত অনুযায়ী আপনা আপনি নির্ধারিত হয় না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কতৃপক্ষই দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্ধারন করে থাকে।
অর্থনীতি
আগামির সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে টাকার ব্যবহার একটি বিতর্কিত বিষয়। কার্ল মার্কস,
রবার্ট ওয়েন , পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ সমাজতন্ত্রীরা টাকার মতো বিভিন্ন ধরনের শ্রম ভাউচারের কথা বলেছেন যার দ্বারা বিভিন্ন ভোগ্যদ্রব্য পাবার কথা এবং একই সাথে সেগুলো পুঁজিতে রূপান্তরিত হবে না।
“
আমার মতে, বর্তমান কালের সংকটের মূলে রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক নৈরাজ্য। ... ... আমি নিশ্চিত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এই মন্দ দিকগুলো দূর করা যেতে পারে; সেইসংগে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার যার উদ্দেশ্য হবে একটি সামাজিক লক্ষ্য স্থির করা। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিকানায় থাকবে সমাজ এবং উৎপাদনের ফল পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার হবে। একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি, যেটি সমাজের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদনের সমন্বয় করবে, প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তির কর্মকে সমভাবে বিতরণ করবে এবং পুরুষ-নারী ও শিশু নির্বিশেষে জীবনধারণের উপায় সুনিশ্চিত করবে। সহজাত উৎকর্ষ এবং সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তির শিক্ষা তার সামাজিক দায়বোধের চিন্তাভাবনা জাগাবে। বর্তমানে যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও সাফল্যের সোপান হিসেবে শিক্ষাকে তুলে ধরা হয়, উল্লেখিত ব্যবস্থা হবে তার বিপরীত।
— Albert Einstein , Why Socialism? , 1949
সমাজতন্ত্র হল সাম্যবাদী সমাজের প্রথম পর্যায়। উৎপাদনের উপায়ে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা হলো এর অর্থনৈতিক ভিত্তি। সমাজতন্ত্র উৎখাত ঘটায় ব্যক্তিগত মালিকানার এবং মানুষে মানুষে শোষণের বিলোপ ঘটায় অর্থনৈতিক সঙ্কটের ও বেকারির, উন্মুক্ত করে উৎপাদনী শক্তির পরিকল্পিত বিকাশ ও উৎপাদন সম্পর্কের পূর্ণতর রূপদানের প্রান্তর। সমাজতন্ত্রের আমলে সামাজিক উৎপাদনের লক্ষ্য_ জনগণের স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি ও সমাজের প্রতিটি লোকের সার্বিক বিকাশ। সমাজতন্ত্রের মুলনীতি হলো প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেকে গ্রহণ করবে তার প্রয়োজন অনু্যায়ী। সমাজতন্ত্র দুই ধরনেরঃ কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছিলো ১৯১৭ সালে।
বৈশিষ্টসমূহ
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান বৈশিষ্ট হল কলকারখানা, জমি এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ সবই সামাজিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন থাকে।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় আয় সুষমভাবে বন্টিত হয়। এই অর্থব্যবস্থায় জাতীয় আয় বন্টনের মূলনীতি হলঃ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। এভাবে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি মুনফার কোন সুযোগ থাকে না।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যানের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। অর্থাৎ সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উতপাদন, বন্টন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষনের কোন সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান সমান সুবিধা ভোগ করে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক প্রয়োজনীয়তা যেমনঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সকল খাতে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উন্নয়ন করা হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা মাফিক সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাই এই অর্থব্যবস্থায় বেকারত্বহীনতা ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় বিধায় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত সঙ্কট দেখা দেয় না।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দ্রব্যের মূল্য পুঁজিবাদের ন্যয় চাহিদা ও যোগানের ঘাত প্রতিঘাত অনুযায়ী আপনা আপনি নির্ধারিত হয় না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কতৃপক্ষই দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্ধারন করে থাকে।
অর্থনীতি
আগামির সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে টাকার ব্যবহার একটি বিতর্কিত বিষয়। কার্ল মার্কস,
রবার্ট ওয়েন , পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ সমাজতন্ত্রীরা টাকার মতো বিভিন্ন ধরনের শ্রম ভাউচারের কথা বলেছেন যার দ্বারা বিভিন্ন ভোগ্যদ্রব্য পাবার কথা এবং একই সাথে সেগুলো পুঁজিতে রূপান্তরিত হবে না।
“
আমার মতে, বর্তমান কালের সংকটের মূলে রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক নৈরাজ্য। ... ... আমি নিশ্চিত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এই মন্দ দিকগুলো দূর করা যেতে পারে; সেইসংগে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার যার উদ্দেশ্য হবে একটি সামাজিক লক্ষ্য স্থির করা। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিকানায় থাকবে সমাজ এবং উৎপাদনের ফল পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার হবে। একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি, যেটি সমাজের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদনের সমন্বয় করবে, প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তির কর্মকে সমভাবে বিতরণ করবে এবং পুরুষ-নারী ও শিশু নির্বিশেষে জীবনধারণের উপায় সুনিশ্চিত করবে। সহজাত উৎকর্ষ এবং সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তির শিক্ষা তার সামাজিক দায়বোধের চিন্তাভাবনা জাগাবে। বর্তমানে যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও সাফল্যের সোপান হিসেবে শিক্ষাকে তুলে ধরা হয়, উল্লেখিত ব্যবস্থা হবে তার বিপরীত।
— Albert Einstein , Why Socialism? , 1949
তৃতীয় অধ্যায়ঃ
চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং-এর অবদান।
ভূমিকাঃ মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চীনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে।মাও সেতুং মার্কসবাদ লেনিনবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও চীনের সনাতন ঐহিহ্যের সংযোগ সাধনের মাধ্যমে তিনি চীনে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটান। মাও সেতুং রুশ সমাজতন্ত্রের পথ ধরে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হন। চীনের সমাজ-সংস্কৃতি ও পরিবেশের আলোকে মার্কসবাদ ও লেনিনের নির্দেশিত প্রক্রিয়ার কিছুটা পরিবর্তন সাধন করেন এবং কয়েকটি মৌলিক তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। চীনের সমাজতান্ত্রিক ইতিহাসে এবং মার্কসবাদ ও লেনিনবাদে মাও সেতুং এর তাত্ত্বিক সংযোজনগুলো "মাওবাদ" নামে পরিচিত। চীনের সমাজতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক অনবদ্য অভিব্যক্তি হলো মাওবাদ। চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং-এর অবদানগুলো তুলেধরা হলো।
১।কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানঃ মাও সেতুং মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। সর্বহারা বা প্রললতারিয়েত শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি পূনগঠন করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয়তাবাদী কুত্তমিনটাং দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মাও সেতুং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করে পার্টিকে জনগনের নিকট গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। পার্টি গ্রামাঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক, ব্যবসায়ী সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
২।চীনে গণবিপ্লব সংগঠনঃ মাও সেতুং-এর যোগ্য নেতৃত্বে ও কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বশীল ভূমিকায় চীনে
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সার্থকতা এসেছে। মাও সেতুং-এর ভাষায়, " Except for the communist party,none of the political parties,bourgeois or petty bourgeois is equal to the task of leading chinas two great revolutions,democratic and socialist to their complete realisation" মাও সেতুং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত "on new democracy" গ্রন্থে চীনের বিপ্লবের প্রকৃতি,লক্ষ্য,তাৎপর্য প্রভূতি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মার্কসবাদ লেনিনবাদকে চীন বিপ্লবে প্রয়োগ করেছেন। মাও সেতুং গ্রামাঞ্চলের গরিব কৃষকদের সংগঠিত করে জাপানি ও কুত্তমিনটাং বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কৌশলে লড়াই-এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী সৈন্যদল গঠণ করেন।প্রধানত এই সশস্ত্র কৃষক।বাহিনীকে নেতৃত্ব দান করে মাও সেতুং ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কুত্তমিনটাং এর সামাজিক ও সামরিক শক্তিকে সূদীর্ঘ সংগ্রামে পরাজিত করে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চীন দখল করেন।
৩।নতুন গণতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠাঃ কৃষি প্রধান চীন দেশে কোটি কোটি কৃষকদের দলে টানতে পারা এক নতুন যুগের উপযোগী "নতুন গনতন্ত্রের"আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটা মাও সেতুং-এর অন্যতম প্রধান কীর্তি। তিনি সকল শ্রেণীর জনগণকে একত্রিত করে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব সংঘটিত করেন। মাও সেতুং-এর মতে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন হতে চীনে বিপ্লবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয় ঘটেছে। on new democracy গ্রন্থে তিনি গণতন্ত্র বলতে চৈনিক ধাঁচের গণতন্ত্রকে নির্দেশ করেছেন। তার মতে, "The democracy of the first step is not democracy is it's general sense but a new special type of a chinese style,the new democracy" নতুন ধরনের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক,পাতি বুর্জোয়া সকলেরই অংশগ্রহণ করে একটি নতুন আদর্শ সৃষ্টি করবে।
৪।জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্বঃ মার্কস শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু মাও সেতুং চীনের নয়া গণতন্ত্রে জনগনের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রমিক,কৃষক,শহুরে,পাতি বুর্জোয়া এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের সমন্বয়ে জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এখানে শ্রমিক শ্রেণীর উপযুক্ত শক্তি ও নির্ভুল নেতৃত্ব থাকলে সকলের সমন্বয়ে।জনগণতান্ত্রিক একনাশকত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
৫।সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন দিক হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মাও সেতুং-এর মতে গণবিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তিনি এ বিপ্লবের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন,"Revolutionary culture is a powerful revolutionary we apon of the people" এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব হলো মতাদর্শগত বিচারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের প্রতিফলন। জনগণের স্বার্থে পরিচালিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল কথা হলো সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন-শোষনের বিরোধিতা এবং চীনের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতিগত বৈশিষ্টের সংরক্ষন। প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে জনগনের ব্যাপক অংশগ্রহণ দ্বারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালিত হবে।
৬।রাষ্ট্রতত্ত্বঃরাষ্ট্রতত্বের অবতারনা মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বা রাজনৈতিক দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ন দিক। মাও সেতুং-এর মতে চীনের বৈপ্লবিক ইতিহাসের দুটি পর্ব হলো গণতান্ত্রিক পর্ব ও সমাজতান্ত্রিক পর্ব। বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক পর্বের উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের গতিকে দ্রুততর করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। চীনে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হলো চীনের সর্বহারা শ্রেণীর এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র দেশের শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্ব ও শ্রমজীবী মানুষের সহযোগিতায় পরিচালিত হবে।
৭।দ্বন্দ্ব তত্ত্বঃ মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন দিক হলো দ্বন্দ্বতত্ত্ব। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে, "on contradiction" এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে,"ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম"নামে প্রকাশিত দুইটি প্রবন্ধে মাও সেতুং তার দ্বন্দ্ববাদের বিবরন দেন। তার মতে দ্বন্দ্ব হবে দুই ধরনের। যথা - ক। অবৈরী দ্বন্দ্ব ও
খ। বৈরী দ্বন্দ্ব।
মাও-এর দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূলকথা হলো শুধু শত্রুর সাথে শত্রুর দ্বন্দ্ব হয় না। মিত্রের সাথেও মিত্রের দ্বন্দ্ব হতে পারে। যে কোন প্রতিরোধ সংগ্রামে কিংবা যে কোন বিপ্লবে শত্রু- মিত্র সঠিকভাবে চিহ্নিতকরা যদিও অপরিহার্য তথাপি এই চিহ্নিতকরণের সাথে সাথে সম্মিলিত প্রতিরোধ সংগ্রামের সকল সমস্যার সমাধান হয় না। কারন শত্রুর সাথে যেমন, একটি বাস্তব সত্য মিত্র শক্তিগুলির সাথে দ্বন্দ্ব ও তেমনি একটি বাস্তব সত্য।এ দু'ধরনের দ্বন্দ্বরই মীমীংসা করা দরকার। তবে এ দু'ধরনের মীমাংসা নিশ্চিয়ই এক ধরনের নয়। মাও তার দ্বন্দ্বতত্ত্বের সকল ধরনের সামাজিক সম্পর্ককে বৈরীমূলক ও অবৈরীমূলক বলে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।
খ। বৈরী দ্বন্দ্ব।
মাও-এর দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূলকথা হলো শুধু শত্রুর সাথে শত্রুর দ্বন্দ্ব হয় না। মিত্রের সাথেও মিত্রের দ্বন্দ্ব হতে পারে। যে কোন প্রতিরোধ সংগ্রামে কিংবা যে কোন বিপ্লবে শত্রু- মিত্র সঠিকভাবে চিহ্নিতকরা যদিও অপরিহার্য তথাপি এই চিহ্নিতকরণের সাথে সাথে সম্মিলিত প্রতিরোধ সংগ্রামের সকল সমস্যার সমাধান হয় না। কারন শত্রুর সাথে যেমন, একটি বাস্তব সত্য মিত্র শক্তিগুলির সাথে দ্বন্দ্ব ও তেমনি একটি বাস্তব সত্য।এ দু'ধরনের দ্বন্দ্বরই মীমীংসা করা দরকার। তবে এ দু'ধরনের মীমাংসা নিশ্চিয়ই এক ধরনের নয়। মাও তার দ্বন্দ্বতত্ত্বের সকল ধরনের সামাজিক সম্পর্ককে বৈরীমূলক ও অবৈরীমূলক বলে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।
৮। লালফৌজ গঠণঃ লালফৌজের প্রতিষ্ঠা মাও সেতুং-এর রাজনীতিক জীবণের অন্যতম সাফল্য। ১৯২৭-৩৭ সাল চীনের বিপ্লবীদের কাছে গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তর নামে অভিহিত। এ পর্যায়েই মাও সেতুং এবং চৌ-এন লাই এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে লালফৌজ (Red Army)গড়ে উঠে।এ বাহিনী নানচাং শহরকে মুক্ত করে গোয়াঙটুং এর দিকে অগ্রসর হয়। গুয়াংঝউ ও গোয়াঙটুং তাদের অধিকারে আসে। পরবর্তীতে এ বাহিনীরই নামকরন করা হয় গণমুক্তি ফৌজ। চীনের স্বাধীনতা সংগ্রামে গণমুক্তিফৌজ পালন করে অগ্রনী ভূমিকা। মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন দিক হলো লালফৌজ গঠণ। মার্কসবাদ যেখানে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ন নেতৃত্ব প্রদান করেছেন মাও সেতুং সেটা অনুসরন না করে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। উল্লেখ্য,যে চীনের সামাজিক বিপ্লব শিপ্লের কেন্দ্র শহরসমূহ ও তার শিল্প শ্রমিকদের শক্তির ভিত্তিতে ঘটেনি। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবি শ্রেণী হিসেবে সংগঠিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু মাও সেতুং বিপ্লবের প্রতিষ্ঠিত পরিক্রমার পরিবর্তে গ্রামাঞ্চলে গরিব কৃষকদের সংগঠিত করে যুগোপযোগী ও কুত্তমিনটাং বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কৌশলে লড়াইয়ের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী সৈন্যদল গঠণ করেন। সমগ্র চীনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর মাও সেতুং কৃষক শ্রেনীর সহয়তায় অপরাজেয়,"লালফৌজ" নামক সামরিক বাহিনী গঠন করেন। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি,"লালফৌজ"গঠন করেন।
৯।উদারনৈতিকতাঃ মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার অন্যমত দিক ছিল উদারনৈতিকতা। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় অনুপ্রনিত মাও সেতুং উদারনৈতিক মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। মার্কসবাদে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু মাও সেতুং বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায়য় নতুন প্রাণস্পন্দন দান করেন। মাও সেতুং তাই বলেন, "Let hundred flowers bloom,let diverse a school of thought contend"মাও সেতুং-এর এই উদারনৈতিক মানসিকতা চীনের সমাজতান্ত্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।
১০।নির্ভূল ও উপযুক্ত নেতৃত্বঃ মাও সেতুং-এর মতে নির্ভূল ও উপযুক্ত নেতৃত্বের গুনে সমাজতন্ত্রবাদ তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছবে। শ্রমিক শ্রেণীর উপযুক্ত শক্তি ও নির্ভূল নেতৃত্বে থাকলে তখন সর্ব শ্রেণীকে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ করে নতুন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
১১।নতুন কৌশল গ্রহণঃ ১৯২০ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থানের প্রথম বছরের মধ্যেই তাদের প্রত্যক্ষ এবং ঘনিষ্ট তত্ত্বাবধানে প্রলেতারিয়েতদের একটি পার্টি গঠন এবং শহরে প্রজাবিদ্রোহ সংগঠিত করার কাজের উপর নির্ভরশীল প্রাথমিক কৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সকল চেষ্টাই বারবার ব্যর্থ হতে থাকলো।১৯২০ সালের শেষার্ধেমএবং ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে এভাবে চীনের গ্রামাঞ্চলে তাদের নিজেদের ব্যর্থতার দ্বারাই তারা বাধ্য হয়েছিল কতোগুলো মূল বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে নতুন কৌশলের বিকাশ ঘটাতে। চীনাদের দেশপ্রেম এবং চীনের নতুন জাতীয়তাবাদী,সংস্কারমনা বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন জানান, চীনা কৃষক।সম্প্রদায়ের মধ্যকার একটি অস্থির ও বিদ্রোহী সুপ্ত শক্তিকে কাজে লাগাবার জন্য একটি ভূমি সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন,একটি শক্তিশালী কৃষকনির্ভর বৈপ্লবিক সেনাবাহিনী, গ্রামাঞ্চলে নিশ্চিত বিপ্লবভিত্তিক তথাকতিত,"Liberated Area"গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ধরণার উপর নির্ভশীল সশস্ত্র সংগ্রামের নমনীয় কৌশলের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যার লক্ষ্য ছিল।
১২।কমিউনিস্টদের কর্মকান্ডঃসিনো- জাপানিজ যুদ্ধে চীনা কমিউনিস্টদের সামনে বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল এবং তারা এর সবটুকু সুবিধা গ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের শুরুতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় কমবেশি চল্লিশ হাজার সদস্য গঠন করে উত্তর পশ্চিমে চীনের বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী এক দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায়,১৯৪৫ সালের মধ্যে এর সদস্যপদ গ্রহণ করলো প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি সদস্য। যা একটি শক্তিশালী গেরিলা সেনাদল গঠন করলো। এটি উত্তর চীনের গ্রামাঞ্চলের বৃহত্তম অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকলো এবং চীনের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হলো যে,কমিইনিজম ভবিষ্যৎ প্রবাহে প্রতিনিধিত্ব করছে,যাকে বলা যায় চীনের মৌলিক নতুন কিছু লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম একটি আন্দোলন;জাতীয় ক্ষমতা এবং অত্ন-শ্রদ্ধা,সামাজিক সংস্কার এরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
১৩।মাওমসেতুং-এর নেতৃত্বঃ ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসের গুইযৌ প্রদেশের জুন-ইতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটবুরো একটি পরিবর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা সামরিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে ওয়াং মিং এর,"বাম" সুবিধাবাদী লাইন শুধরে নেয়। সমগ্র পার্টির উপর মাও সেতুং-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সেই সময় থেকে চীন বিপ্লবের জয়যাত্রা শুরু হয়।
১৪।পার্টির প্রসারঃ গণফৌজ আর জাপানবিরোধী ঘাঁটি এলাকাগুলোতে সম্প্রসারিত করে এবং আগ্রাসী আক্রমনকারীদের উপর ফলপ্রসূ আঘাত হেনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি উৎপাদনের প্রসার ঘটাতে এবং নিজেদের প্রচেষ্টার বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠতে জনসাধারনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের সময়ে গণজোট বাহিনীগুলোর সৈন্যসংখ্যা দশ লাখ এবং মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাইশ লাখ পৌঁছেছিল। মুক্ত এলাকাগুলোর মোট জমসংখ্যা ছিল দশ কোটি চীনা জনগনের বিপ্লবী শক্তি দ্রুত বেড়ে চলছিলো।
১৫।চূড়ান্ত পর্বঃ ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে জিয়াং জিয়েশি মুক্ত এলাকাগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্বক আক্রমন পরিচালনা করেন। কিন্তু মুক্ত এলাকাগুলো ও জিয়াং নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর জনসাধারনের সহযোগিতায় চীনা গনমুক্তি ফৌজ তিন বছরের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মোট ৮০ লাখ জিয়াং সেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মুক্ত করে এবং এভাবে জিয়াং-এর শাসন সম্পূর্ন নিশ্চিহ্ন কারে দেয়। অতঃপর সেখানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়।
চতুর্থ অধ্যায়ঃ
চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুং-এর সমালোচনা।
ভূমিকাঃ মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও মাং সেতুং নিজস্ব চিন্তাধারার সাথে মার্কসবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। কিন্তু মাও সেতুং-এর তাত্ত্বিক ধারনা বা মতবাদ সমালোচনার উধ্বে ছিলোনা। নিচে মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সমালোচনা সমূহ তুলে ধরাহলো।
(ক) ভ্রান্ত ধারণাঃ চীনের সাবেক উপ-প্রধাণমন্ত্রী তেং-এর মতে মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বা রাজনৈতিক দর্শন শতকরা ৩০ ভাগ ভ্রান্ত।
(খ) কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণ অসম্ভবঃ কৌশলগত কারনল বুর্জোয়া শ্রেণী যুক্তফ্রন্টে অংশ গ্রহণ করতপ পারে। কিন্তু কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব রার্ষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে পারে না।
(গ) ভ্রন্ত দ্বন্দ্বনীতিঃ একাধিক মার্কসবাদী গবেষক মাও সেতুং-এর দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে ভ্রান্ত বলে মনে করেন। তাদের মতে দ্বন্দ্ব বৈরীতার পরিপ্রেক্ষিতেই সংঘটিত হয়। অবৈরীতা থেকে কখন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় না। তাই মাও সেতুং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব নীতিকে ভ্রান্ত দ্বন্দ্ব তত্ত্বনীতি বলা যায়।
(ঘ) জনগনতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাঃ মাও সেতুং জনগনতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাকরে বুর্জোয়াদের প্রতি সহনশীল মনোভাব দিয়ে তাদেরকে পুনরায় সংগঠিত হবার সুযোগ দিয়েছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ঃ-
চীনে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধরায় মাওবাদ এর মূল্যায়ন।
ভূমিকাঃ রক্ষনশীল মনোভাব চীনে বেশ উদারতা লাভ করেছে। ব্যবসা বানিজ্যে পুঁজিবাদী ধরনের মনোভাব,রাজনীতিতে আরো বেশী সহনশীলতা এবং গণতন্ত্রীকরনের প্রয়াস,অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে যুগোপযোগীভাবে পূর্নগঠণ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে উদারতা প্রদর্শন চীনা সমাজতান্ত্রিক সমাজকে বহির্বিশ্বের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলবে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।
মূল্যায়নঃ বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় মাও সেতুং অনেকটা উদারনৈতিক মানসিকতা নিয়ে সমাজতন্ত্র ও রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং তার কার্যকারী করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে এবং চীনের সামগ্রিক অগ্রগতির লক্ষ্যে তিনি একটি জাতীয় রার্ষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠার নিয়েছিলেন। সকলের সহযোগিতা ও সমন্বয়ই হবে জাতীয় গণতন্ত্রের আদর্শ - এ ধারনার সার্থক রুপায়নে মাও সেতুং কৃতকার্য হন। সমাজতন্ত্র বা রজনীতি সম্পর্কে মাও সেতুং-এর চিন্তাধারা পরবর্তীতে পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে অনুকরনীয় হয়েছে।
উপসংহারঃ চীনে ১৯৪৯ সালে যে সমাজতান্ত্রিক অদর্শের যাত্রা শুরু হয়েছিলো তা এখন ঝিমিয়ে পড়ার আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গোটা বিশ্বে এখন সমাজতান্ত্রিক সংকট চরম বিপর্যস্ত। এমনি এক ক্রান্তিকালে চীনের সমাজেও তার ছোঁয়া লেগেছে বৈকি। মাও সেতুং চীনা সমাজতন্ত্রে যে অবহ তৌরি করেছিলেন তা থেকে চীন অনেক আগেই কিছুটা বিচ্যুত হলেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির তেমন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেনি চীনে। কট্টরপন্থী উদার অথবা মধ্যম কিসিমের নেতৃত্বের কারনে চীন সমাজতন্ত্রের পথ নানা স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। প্রথাগত বা নীতিগত সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারনার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। রক্ষনশীল মনোভাব এখন বেশ উদারতা লাভ করেছে চীনে। কমিউনিজমের চিরন্তর বাস্তবতার ধারনা। যে আদৌ ঠিক নয় অন্তত অতটুকু সত্যের প্রমান দিচ্ছে চীনের সমকালীন রাজনৈনিক কর্মকান্ড।
ধন্যবাদ
ردحذفধন্যবাদ।
ردحذفস্বাগতম
حذفচিনে সমরনায়ক বাদ উৎপত্তি
ردحذفধন্যবাদ
حذفআমাকে চীনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাও সেতুর ভূমিকা,
ردحذفএসাইনমেন্ট লাগবে
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,আপনার নাম ঠিকানা সহো বিস্তারিত জানান।
حذف