নৈতিক অবক্ষয়ে দেশ

পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয় নৈতিক শিক্ষা দিতে পারেনা। নৈতিকতার কোন নীতিমালা বা নৈতিক শিক্ষার আজ পর্যন্ত কোন বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়নি। নৈতিক শিক্ষার একমাত্র তীর্থস্থান নিজের পরিবার ও সমাজ। অর্থাৎ একমাত্র পরিবার ও সমাজথেকে মানুষ নৈতিক শিক্ষা অর্জন করে।কোথাও বলা হয়নি শিক্ষকের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। ভালো আচরণ না করলে তেমন কোন শাস্তির বিধান নাই। তবুও আমরা শিক্ষকের সাথে ভালো ব্যবহার করি। যা যুগ যুগ ধরে চলে  আসছে আর আমরা এটাকেই নিয়ম মেনে আসছি।সৃষ্টিকর্তাকে মানতে কেউ কোন দিন বাধ্য  করেনি, তবু আমরা সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি।এসব সামগ্রিক বিষয়গুলোই হলো নৈতিকতা।মূলত নিয়মনীতি বা রীতিনীতি গুলোই হলো নৈতিকতা। কারো বিপদে যেমন হাসাহাসি করা নৈতিকতার বিরোধী ঠিক তেমনি কারো অর্জনকে ছোট করে দেখে হেঁয়ালি করা নৈতিকতা বিরোধী।আমার পরিবার আমার কে শিখিয়েছে  কানাকে কানা বা অন্ধ,খোড়াকে খোড়া বা ল্যাংড়া না বলা। এতে তারা অনেক কষ্টপায়। ঠিক তেমনি তারা আমাকে শিখিয়েছে কারো মৃত্যুতে উল্লাসে মেতে না উঠা।কারো মৃত্যু হলে শোক প্রকাশ করা, সেই সাথে মৃত্য ব্যক্তির খারপ দিকগুলো আলোচনা না করে ভালো দিক গুলো নিয়ে আলোচনা করার শিক্ষা সমাজ থেকে পেয়েছি।এ শিক্ষার কারনে গত কিছুদিন আগে আমাদের জাত শত্রু দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করলেও উল্লাসে মাতিনি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। কাদের মোল্লার ফাঁসিতে যেমন আনন্দ উল্লাস করেছিলাম ঠিক তেমটি করার কথা ছিল। তবে তেমনটি হয় নি কারন সাইদী যেমন আমার কাছে একটা ঘৃণার নাম ঠিক তেমনি সাইদী কারো কাছে একটি আবেগের নাম। তবে হ্যাঁ যদি সাইদীর ফাঁসি হতো তবে অবশ্যই উল্লাসে ফেটে পরতাম।

এতোদিন যা দেখে এসেছি তা আকর্ষিক ভাবে পরিবর্তন হলো। বাংলাদেশ এক ভয়াবহ নৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনা ঠিক তেমটাই ইংগিত দিচ্ছে। চট্টগ্রামে কয়েকদিন আগে ট্রেনের থাক্কায় তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। সে খবর দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যম প্রকাশিত হয়। সে সব সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজের কমেন্টে গনহারে সবাই আলহামদুলিল্লাহ লিখে কমেন্ট করেছে। কারো মৃত্যু সংবাদ শুনলেই(সে পরিচিত / অপরিচিত হোক না কেন) যেখানে ইন্না-লিল্লাহ পড়ার কথা সেখানে প্রায় সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়ছে!একজন পুলিশ সদস্য বাংলাদেশের নাগরিক,তিনি আপনার আমার মতো, কারো ভাই,কারো বন্ধু,কারো পিতা,কারো স্বামী, কারো না কারোতো স্বজন। একবার চিন্তা করে দেখেনতো সেদিন পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের কি অবস্থা হয়েছিল।আর আপনারা আলহামদুলিল্লাহ পড়ছেন।আচ্ছা একজন পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুতে আপনাদের কি লাভ? জানি বাংলাদেশ পুলিশ আজ ঘৃণার নাম তবুও সব পুলিশ তো আর এক নয় ভাই।
দেশে রাজনীতি সবসময় হানাহানি ও কাটাকাটির। বাংলার রাজনীতিতে গুম হত্যা খুন নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলার জন্মের পূর্ব থেকেই রাজনীতিতে এমন হানানির রাজনীতি চলে আসছে। প্রতিপক্ষের আঘাতে কেউ আহত বা নিহত হলে অন্য পক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়ে, অপরদিকে অন্যপক্ষের শোকের কালো ছায়া নেমে আসে।
 তেমনটি ঘটেছিল গত ২৮ শে অক্টোবর। আওয়ামীলীগ-বিএনপি'র পাল্টাপাল্টি সমাবেশে বিএনপির কর্মীদের হাতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। পুলিশ সদস্যটি আবার ব্যাচমেট হওয়ায় বিভিন্নভাবে তার প্রতি সহানুভূতি জেগে ওঠে। অপরদিকে সেদিন শুধু পুলিশ সদস্যই নিহত হয়নি বিএনপির কর্মী  নিহত হয়েছে তার প্রতি কিন্তু সহমর্মিতা জেগে ওঠেনি এবং তার প্রতি সহানুভূতি  প্রকাশ্য করা হয়নি।



  আমরা এমন এক নৈতিক অবক্ষয়ের সময় পার করছি, যার জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনেকদিন ধরে ভুগতে হবে। আমরা আগে থেকেই জানি বাংলাদেশের শ্রম পৃথিবীর সর্বোচ্চ সস্তা শ্রমগুলোর একটি। সর্বোচ্চ সস্তা শ্রমের দিক থেকে  থেকে চা শ্রমিকদের পরেই পোশাক শ্রমিকদের অবস্থান। যদিও বাংলাদেশের পোশাক শিল্প পৃথিবীর মধ্যে  কখনো প্রথম ও কখনো দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করে আসছে। তারপরেও বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের বেতন খুব নিম্নমানের। প্রতিবছর নামমাত্র মজুরি বৃদ্ধি হয়,যা দিয়ে একজন শ্রমিকের দিনযাপন  করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এজন্য সরকার প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সর্বশেষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি ধার্য করা হয়েছে। সেই হিসেবে  ২০২৩ সালের শেষের দিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করার সময়  এসেছে। তবে মালিকপক্ষ বিভিন্নভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গড়ি মসি করছে,তারা একের পর এক তারিখ পরিবর্তন করে আসছে। তারা যা মজুরি নির্ধারণ করার প্রস্তাব উপস্থাপন  করেছেন,তা দিয়ে বর্তমানে  একজন শ্রমিকের কোনো ভাবে দিন পার করা সম্ভব না। যেখানে দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে। যেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিটি যেমন ভিত্তিহীন,তেমনি মালিক পক্ষের ১০ হাজার ৪০০ টাকা সর্বনিম্ন মজুরি করার প্রস্তাবটিও অযৌক্তিক। বর্তমান সময়ে একজন মানুষের পক্ষে দশ হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালানোটা মুশকিলেই নয় অসম্ভব এ বটে। 

বেতন বৃদ্ধি নিয়ে মালিক ও পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকদিন থেকেই দরকাষাকষি চলছে কিন্তু কোন পক্ষেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না।এতে শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট ও অধৈর্য হয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ছে। এ আন্দোলনে সকল শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকার কথা থাকলেও। শুধুমাত্র কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছে। এদিকে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে অনেক কারখানার শ্রমিকরা টু শব্দ করছে না। যা শ্রমিকদের  বর্তমান-ভবিষ্যৎ কোনোটি   ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসবে না।সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ার ফলেই আমরা আজ বারংবার  নির্যাতিত নিষ্পেষিত হয়ে আসছি। তবে যতদূর শুনেছি মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে উদ্ভট পরিস্থিতি সৃষ্টির ফলে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি দেখছেন। আশা করছি খুব দ্রুতই প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপে একটি সম্মানজনক ন্যূনতম মজুরি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন