সরকারের আয় নেই।অতিমূল্যস্ফীতির দিকে দেশ। বাজারে কোন পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ নেই বল্লেই চলে।আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।দেশটি পড়েছে ঋণের মরণ দশায়।খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত,ভুল নীতি,ভুল প্রকল্প বাছাই এবং দুর্নীতির কারণেই শ্রীলঙ্কার আজকে এই অবস্থা।
২০০৬ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে শ্রীলঙ্কার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল।সে সময় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার,যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।শ্রীলঙ্কা ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হয়েছিল।কিন্তু কোনো অর্জনই ধরে রাখতে পারেনি।প্রবৃদ্ধি কমতে থাকলে পরের বছরেই বিশ্বব্যাংক তাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে নামিয়ে দেয়।এরপর রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি আয়ে দেখা দেয় বড় ভারসাম্যহীনতা।মূলত গত দুই বছরে, অতিমারির সময়ে।সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বিপদে পড়ে শ্রীলঙ্কা যদিও ২০১৯ সালের দুটি ঘটনাকেই শ্রীলঙ্কার এমন দশার জন্য দায়ী করা হয়।ওই বছর কলম্বোয় তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে মৃত্যু হয় ২৫৩ জনের।এরপর পর্যটনেও ধস নামে। জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১০ শতাংশ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ বাড়ে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে নিজেই।জনপ্রিয় পদক্ষেপ হিসেবে এক ধাক্কায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ ধার্য করেন।একই সঙ্গে ২ শতাংশ হারের নেশন উন্নয়ন কর (নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স), যত আয় তত কর (পে অ্যাজ ইউ আর্ন—পিএইউই) ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। এর প্রভাব পড়ে রাজস্ব আয়ে। এক বছরেই দেশটির ভ্যাট আদায় কমে যায় ৫০ শতাংশ।
এরপর শুরু হয় কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ।এতে দুই বছরে প্রবাসী-আয়, পর্যটন, রপ্তানি—সবকিছুই কমে যায়।কোভিডে বিশ্বের সব দেশের সরকারই খরচ বাড়িয়েছে, অর্থনীতিতে দিতে হয়েছে প্রণোদনা। শ্রীলঙ্কাও বাজেটে ব্যয় বাড়াতে হয়েছে।অথচ আয় কম।এর মধ্যেই ঢুকে পড়ে অর্গানিক সারের পক্ষের (লবিস্ট) গ্রুপ। এই গ্রুপটির পরামর্শে গোতাবায়া রাজাপক্ষে ২০২১ সালের মে মাসে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের চাপ কমাতে রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করেন।শুরুতে বাহবা পেলেও এর ফল হয় মারাত্মক বিপর্যয়কর।করোনার সময় শ্রীলঙ্কা টিকে গেছে কৃষি খাতের কারণে।উৎপাদন ভালো হওয়ায় খাদ্যসংকট হয়নি।
শ্রীলঙ্কার ঋণের হার এখন জিডিপির ১১৯ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় সব মিলিয়ে এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি।শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডে।এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ, জাপানের কাছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চীনের কাছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, ঋণের দায় পরিশোধ হিসেবে চলতি বছর শ্রীলঙ্কাকে সব মিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ দেওয়া কথা।অথচ এখন শ্রীলঙ্কার হাতেই আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। সুতরাং ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই নতুন করে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে।অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগও কমেছে গত দুই বছরে।
চীনের ঋণের ফাঁদে বন্দী শ্রীলঙ্কা।একাধিক অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।যেমন, গভীর সমুদ্রবন্দর হাম্বানটোটা নির্মাণের জন্য চীন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এই সমুদ্রবন্দর থেকে আয় হয় সামান্য।ফলে পরিচালনার জন্য চীন থেকে নেওয়া হয় আরও ৭৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার—২ শতাংশ সুদ হারে।তাতেও কাজ হয়নি।পরে চীনের কাছেই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে।চীনের ঋণে করা আরেক ‘শ্বেতহস্তী’ প্রকল্প হচ্ছে মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে করা এই বিমানবন্দরেরও আয় থেকে ব্যয় বেশি।এই বিমানবন্দরকে এখন বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ফাঁকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
২০০৭ সাল থেকে রাজস্ব আসে না এমন প্রকল্পে শ্রীলঙ্কা বাণিজ্যিক ঋণ নিয়েছে। ২০১৯ সালে করবিরতির কারণে এই সংকট আরও বেড়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। কোনো সরকারই এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়নি। গত দুই বছরে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব কমে যাওয়ায় ঋণের বোঝা বেড়েছে।
শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ কয় হাত দূরে
শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশর পরিস্থিতি এক নয়।তবুও এখানে অনেক বড় বড় প্রকল্পের লাভ ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন আছে।বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। প্রবাসী আয়ও কমছে। একদিকে আমদানি ব্যয় যেমন নতুন রেকর্ড ছাড়াচ্ছে, চলতি হিসাবের ঘাটতিতেও তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড।
ঋণ পরিশোধের দায়ের দিক থেকে বিপজ্জনক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ।অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ।গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে।বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ।বাংলাদেশেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি।এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভেও টান পড়বে।এতে রিজার্ভের অর্থ অবকাঠামো প্রকল্পে খরচ করার সুযোগ কমে আসবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে পোশাক খাত,যা ঐ শ্রীলঙ্কা থেকেই বাংলাদেশে এসেছিল।আর প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক আয়।স্পেড ট্রাম,তাজরিন,রানা প্লাজার ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাক খাতকেও নাড়া দিয়েছিলো।এই খাতের উপর সরকারের মনোভাব,মালিক পক্ষের নির্যাতন,বিভিন্ন বিষয়ে বায়ারের চাপ,রাজনৈতিক অস্থিরতা,সর্বপরি কিছু হিন মানুষের জন্য বাংলাদেশের পোশাক খাত আজ প্রশ্নে মূখে।কিছুদিন আগেও পোশাক খাতে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে ছিলো।কিন্তু এখন বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থান হারিয়েছে।এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদশকেও একসময় শ্রীলঙ্কার মতো পোশাক খাত হারাতে হবে।
গত কয়েক বছরে প্রবাসী আয়ও আশংকাজনকহরে কমে গেছে।এর কারন হিসেবে উল্লেখ করা যায়,প্রবাসীদের উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় সম্মান না দেয়া,নিজ পরিবারের আপনজের কাছে অবমূল্যায়ন,রাষ্ট্রের পক্ষে থেকে বিভিন্নভাবে হয়রানি।প্রবাসে থাকাকালিন রাষ্ট্রের অসহযোগিতা ইত্যাদি কারনে প্রবাসী আয় কমে গেছে।এভাবে চলতে থাকলে এমন একদিন আসবে যে দিন বাংলাদেশের প্রবাসী আয় শূন্যের কোটায় চলে আসবে।তখন বাংলাদেশ আজকের শ্রীলঙ্কায় পরিনত হবে।
বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সবসময় বাড়তি।আর রমজান মাস আসলে তা আরো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে,যা সাধারন মানুষের জন্য খুবেই কষ্টদায়ক।উদাহরণ হিসেবে এবারের রমজানের কথাই বলা যায়,যে এবারের রমজানে বেগুনের দাম এতো বেড়েছে যে,প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি খেতে বলছেন।এ থেকে কি বুঝা যায়?দেশ পরিচালনার কলকাঠি কি প্রধানমন্ত্রীর আছে।যদি না থাকে তাহলে তাহলে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার থেকে আর কতো হাত দূরে বুঝে নিবেন।
শ্রীলঙ্কার এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদূৎতের সংকট দেখা দিয়েছে।এমনি একটা কারখানায় কাজ করি গত এক সপ্তাহ থেকে বিদূৎ যায় আর আসে অবস্থা,দিনের অর্ধেক বেলাই গ্যাস ও বিদূৎ থাকে না।এতে কারখানাগুলো অনেক ক্ষতির সম্মূখিন হচ্ছে।যার প্রভাবে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা এখন সময়ের ব্যাপার।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশও কিছু খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত, ভুল নীতি, ভুল প্রকল্প বাছাই এবং দুর্নীতির বিষয় জরিয়ে আছে।রুপপূর বিদ্যুৎ কেন্দ্র,মেট্ররেল,নতুন বিমান বন্দর ও র্টামিনাল,খেলার মাঠ নির্মানের মাধ্যমে বাংলাদেশ খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত গ্রহন করছে,যার ফলে খুব সহজে শ্রীলঙ্কার সমান হতে পারবে বাংলাদেশ।
বড় বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, যার প্রায় সব কটিই অবকাঠামো প্রকল্প।এতে সুদের হার বেশি, ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে, অর্থ খরচের জবাবদিহি কম এবং এ সবের একটি কাজও সময়মতো শেষ হয়নি। সময় বেড়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। এতে এর অর্থনৈতিক মূল্যও কমে যাচ্ছে।বড় বড় প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশর এখন ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা। নিতে হবে বেশি সুদের ঋণ। এতে দায় পরিশোধও বাড়বে। ফলে এখন থেকেই ঋণের দায় নিয়ে সতর্ক হতে হবে।