কর্মহিনরা কর্মপাক মে দিবস সফল হোক

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা সচরাচর মে দিবস নামে অভিহিত। প্রতি বছর পয়লা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

ঐতিহাসিক এ মহান ‘মে দিবস’ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এবং বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন।দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রদান অতি জরুরী ।
এক অর্থে সব শ্রমজীবী মানুষকে শ্রমিক বলা যেতে পারে। শুধু পরিবহন, পোশাক কিংবা কলকারখানায় কাজ করা, নিচের পদের মানুষকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য না করে কায়িক পরিশ্রম করা মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। হোন তিনি দিনমজুর কিংবা চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী। সবাই শ্রম দিচ্ছেন যার যার স্তরের শ্রমিক হিসেবে।




বাংলাদেশে মে দিবসে সরকারি ছুটি। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়ে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল , ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে


 আজো শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়।বাংলাদেশে মে দিবস বা শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য় শুধুমাত্র কাগজে-কলমের মধ্যসিমাবদ্ধ।বাস্তবে শ্রমিকদের জীবনে মে দিবস অতটা গুরুত্ববহন করেনি।যদিও মে দিবসে শ্রমিকদের প্রধান দাবিছিলো দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার,কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকরা  এখনো ১৬-১৮  ঘন্টা কাজকরে।এছাড়া শারিরীক,মানসিকভাবে নির্যাতন তো নিত্যদিনের ঘটনা।বাংলাদেশে একমাত্র পোশাকশিল্পে ৪০ লক্ষের উপরে শ্রমিককর্মরত।এতোবড় একটা সেক্টরের শ্রমিকদের জীবনে,মে দিবসের সরকারি ছুটিছাড়া আর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়না।এ সেক্টরের শ্রমিকদের এখনো ৮ ঘন্টার উপরে কাজকরতে বাধ্য করাহয়।কখনো কখনো সাপ্তাহিক ছুটিরদিনেও বিভিন্ন অযুহাতে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

কিন্তু দূঃখের বিষয় এই যে,মে দিবসে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা,কলাম লেখক,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘটাকরে মে দিবস পালন করলেও,শ্রমিকদের স্বার্থের বিষয়টি আড়ালেই থেকে যায়।কেউই শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘন্টার বিষয়টি মূখে আনতে চায়না। 

সাংবাদিকরা একটি দেশের দর্পন।কিন্তু বাংলাদেশের এই দর্পন সমাজ শ্রমিকদের বিষয়ে একেবারেই নিরব ভূমিকা পালন করে।কিন্তু অনান্য বিষয়ে সাংবাদিকরা ঠিকই দর্পনের উৎকৃষ্ট ভূমিকা পালন করে।বছরে ৩০০ দিন শ্রমিকরা সকাল ৮ টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করলেও কোন সংবাদ মাধ্যমের বিষটা চোখেপরে না।

২০২০ সালের এমন একটি ঘটনা আমাদের প্রমানকরে যে,বাংলাদেশের শ্রমিকরা কতোটা নির্যাতিত।সেদিন ছিলো পহেলা মে শ্রমিক দিবস,বাংলাদেশের সকল শিল্পকলকারখানা বন্ধথাকলেও চিত্রনায়ক অনন্তজলিলের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের কাজকরতে বাধ্য করাহয়!সেদিন বিষয়টি কিছুকিছু সংবাদমাধ্যম তুলে ধরলেও,জলিলের তেমনকিছু করতে পারেনি।বরং বিভিন্ন কারন দেখিয়ে সে পারপেয়ে গেছে।মে দিবসকে কতোটা তুচ্ছকরলে ঐ দিন শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্যকরাহয় বিষটা কি বুঝতে পারছে?৩৬৫ দিনের মধ্যে শ্রমিকদের জন্য একটি দিনেই বরাদ্দ থাকে,সেদিনেই যদি শ্রমিকদের কাজকরতে হয়,তাহলে ৩৬৪ দিন শ্রমিকদের জীবনে কি হয় তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

সারাবিশ্বে বর্তমানে করোনা বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত।বাংলাদেশও এর বাইরে নায়।এইমহামারিতে অনেক শ্রমিকরা কর্মহিন হয়ে পরছে,কোথাও কোথাও শ্রমিক ছাটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে।সারা দুনিয়ার মানুষ যখন ঘরেবসে দিন কাটাচ্ছে,ঠিক সেইসময়ে শ্রমিকরা জীবনের ঝুকিনিয়ে কাজকরছে।তারপরও শিল্পমালিক এমনকি সরকারও শ্রমিকদের জন্য কিছু করছে না।শুধু মাত্র ২০২০ সালে একমাস সাধারন ছুটিদিলেও অনেক কারখানা শ্রমিকদের পাওনা টাকাদিতে গড়িমসিকরে।সেসময় কারখানা মালিকদের জন্য সরকার প্রনদনা ঘোষণা করলেও শ্রমিকরা কিছুই পায়নি।২১ সালে আবার করোনা প্রকোপ বাড়লে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধঘোষনা করলেও শিল্পকারখানা খোলারাখে,কিন্তু শ্রমিকদের বিষয়টা বেমালুম ভূলেযায়।মুখে মুখে শ্রমিকদের স্বার্থের কথা আওরালেও,কাজে কর্মে আমরা তার ধারের কাছেও যাই না। 

এরপরও শ্রমিকরা মুখবুঝে সবকিছু সহ্যকরে যায়।তারা তাদের নিয়তিকে মেনেনেয়।তবুও এদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না।যুগে যুগে এরা নির্যাতিত হতেই থাকে।হয়তো মালিকের হাতে নয়তো সরকারের হাতে কখনো কখনো এরা নিজেদের হাতেও নির্যাতিত হয়।

উল্লেখ্য, গত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় পোশাক তৈরি কারখানা ভবন ধসে পড়ে। এতে পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হলেন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে অঙ্গ হারিয়েছেন ২৭ জন।
২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের পলাশবাড়ির শাহরিয়ার ফ্যাব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজের ভবন ধসে ৬২ জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১০ সালে ১ জুন তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ভবনধসে ২৫ জনের মৃত্যু, ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টস ভবনে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ শ্রমিকের মৃত্যু, আশুলিয়ার প্রাণকেন্দ্রের একটি ভবনধসে কয়েকজনের মৃত্যু এবং গাজীপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পুরান ঢাকার চকবাজার ও বনানীর বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকসহ অনেকের প্রাণহানির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের নিদারুণভাবে শোকাহত ও বেদনাহত করে রেখেছে। তাই আজ নিহত ও আহত সব শ্রমিকের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জানানো অপরিহার্য।

যদিও বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট তথাপি কর্মক্ষম শ্রমিকের সংখ্যাও কমনয়।দূর্নীতি স্বজনপ্রতির কারনে যোগ্য লোকজন সঠিক কর্মপায়না।এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্যহোক "কর্মহিনরা কর্মপাক মে দিবস সফল হোক"।

মূলতো বাংলাদেশের  সামগ্রিক উন্নতির মূলে সৃজনশীল গরিব শ্রমিক। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া যেমন কাম্য নয়, তেমনি সবার শ্রমিকবান্ধব হওয়াও বাঞ্ছনীয়। পরিবহন শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার শ্রমিকসহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সব শ্রমিকের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে মালিক পক্ষকে সব গাফিলতির ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায্য মজুরি প্রদানসহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করা জরুরি। তবেই হবে মহান ও ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’-এর অঙ্গীকার পূরণ এবং ‘এ দিবস’ হবে সার্থক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন