পিতা-মাতাঃ সন্তানের পরিনতি

চারদিক শুনশান কারও মূখে কোন কথানাই।সবাই নিরব নিস্তব্ধ দাড়িয়ে আছে কেউ কেউ মাঝে মাঝে ফিস ফিস করে এটা ওটা বলাবলি করছে।রফিক সাহেবের স্ত্রী ও এক বযস্ক মহিলা একটা ঘরে ঢুকছে।দরজার কাছে আসতেই রফিক সাহেবের স্ত্রী তার কাছথেকে চিরবিদায় নিচ্ছে।রফিক সাহেব স্ত্রীর হাতে হাত রেখে অনেক কিছুই বলতে চাইছে কিন্তু মুখদিয়ে কোন কথা বেরুতেই চাইছেনা,দুজনের চোখঁদিয়ে অঝড়ধারায় অশ্রু ঝড়ছে।বয়স্ক মহিলাটি রফিক সাহেবের স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে ঢুকার পরেও ঘরের বাইরে রফিক সাহেবের পাড়া-প্রতিবেশী সহ আরও অনেকের সাথে তার শ্বাশুড়ীও দাড়িয়ে আছে।সবাই মনেমনে দোয়া দরুদ পরছে।বেশ কিছু সময় পর,যে যায়গাটা নিরব নিস্তব্ধ ছিল তা ক্রমেই কোলাহলপূর্ন হয়ে উঠল।বাইরে রফিক সাহেবের বড়ভাই নামাজের সময় না হলেও আজান দিচ্ছে কেউ কেউ আবার মধু খুজছে।রফিক সাহেব বুঝতে পারলো বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে একটি সুখবর এসেছে,তার ও তার স্ত্রীর কোলজুড়ে পুত্র সন্তান এসেছে।এটা শুনেই রফিক সাহেব দোকান থেকে মিষ্টি এনে সবার মাঝে বিলিয়ে দিল।


এটাই ছিল রফিক সাহেব ও তার স্ত্রীর প্রথম সন্তান।সন্তন জন্মের পর হতেই রফিক সাহেব ও তার স্ত্রীর নিয়ন্ত্রিত জীবন শুরুহয়।চাকরির সুবাদে বাইরে থাকলেও রুটিন করে প্রতিদিন স্ত্রীও তার সন্তানের খবর নেয়।এদিকে তার স্ত্রীর সকল ভাবনাজুড়ে থাকে তার এক মাত্র পুত্র সন্তান।তাকে মানুষ করতে দিনরাত দুজনে কঠর পরিশ্রম করতে লাগলে।পুত্র সন্তানটির একটি ভালো নাম,রাশেদ রেখে মহা ধুমধামে আকিকা করা হল।রাশেদ একটু বড় হতেই অনেক খেলনার মালিক হয়ে গেল।ছোটবেলা থেকেই রাশেদ একটু জেদি স্বভাবের ছিল।সে যেটা নিতে চাইতো সেটা নিয়েই ছাড়ত।এনিয়ে তার বাবা-মাও কোন অক্ষেপ করতনা। তারা বলত তাদের এক মাত্রইতো সন্তান,তার যা কিছু করছে তা সবেইতো তার জন্য।

এমনি একদিন একদিন বাবা- মায়ের সাথে মেলায় গেল রাশেদ।মেলা একটা খেলনা সাইকেল দেখে লোভ সামলাতে পারলোনা,সেটা নিতেই মা-বাবার কাছে বায়না ধরল।রফিক সাহেব কিছু মনেনা করেই সাইকেলটা
নিয়ে দিল।এভাবে খুব আদর যত্নে রাদেশ বড় হতে থাকলো।রাশেদের বয়স যখন ছয় বছর তখন বাবা-মায়ের কাছে একটা সত্যিকারের সাইকেল দাবি করে বসলো।এবারও রফিক সাহেব সাইকেলটি কিনে দিল।তখন থেকেই সাইকেলটি রাশেদের প্রিয় হয়ে উঠে।

সাইকেল পেয়ে রাশেদ আরও দূরন্ত হয়েপরে।সাইকেলে করে এখানে ওখানে সবসময় ঘুরে বেড়ায়।বাড়ীর কেউ সামান্য ফরমাইজ করলেই তা পালন করতে রাশেদ সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরে।এভাবে খুব ভালো ভাবেই রাশেদ প্রাইমারী লেভেল পার করল।হাই স্কুলে উঠার দুই বছর বাদের রাশেদের মধ্যে আর আগের মত সাইকেল প্রেম দেখা যায়না। আগে সাইকেল ছাড়া যেই রাশেদ এক পাও কোথাও যেতে চাইতো না,সেই রাশেদ এখন সাইকেল ছাড়া স্কুলে যায়,আগের মত আর সাইকেলটার যত্নও নেয়না

এর কিছুদিন পর রাশেদ তার বাবা রফিক সাহেবেকে তার জন্য মটর সাইকেল নিতে বলে।সে সময় চাকরি নিয়ে রফিক সাহেবে সমস্যা থাকার পরেও ছেলের দাবিপূরণ করতে চায়,কিন্তু তার স্ত্রীর আবদারের কারনে তা পূরণকরতে পারেনা।রফিক সাহেবর স্ত্রী তাকে বলছিল কোন ভাবেই এসএসসির আগে তাকে মটরসাইকেল দেয়া যাবেনা।এটা কোনভাবে রাশেদ যেনেযায়,যে তার মায়ের কারনে মটরসাইকেল নেয়া হচ্ছেনা।এরপর থেকেই রাশেদের আচার-আচরনে পরিবর্তন দেখা যায়।রাশেদ আগের মত আর মায়ের সাথে কথা বলেনা,পড়াশুনা করেনা,স্কুল থেকে প্রায় অভিযোগ আসতে থাকে রাশেদ ইদানিং স্কুল ফাকিঁ দিচ্ছে।

এটা শুনার পরেই রাশেদকে একদিন তার মা ডেকে এসবের কারন জানতে চায়।রাশেদ তখন তাকে জানিয়ে দিল মটর সাইকেল না দিলে সে আর স্কুলে যাবেনা।তার মাও তাকে জানিয়েদিল ভালভাবে এসএসসি পাশকরার পর তাকে মটরসাইকেল কিনে দিবে।কিন্তু রাশেদ ইদানিং পড়াশুনায় খুব দূর্বল হয়ে পরেছে।সে নিজেই বুঝতে পারে তার পক্ষে ভালোভাবে এসএসসি পাশ করা সম্ভব নয়।অতঃএব তার আর মটরসাইকেল নেয়া হবে না।রাশেদ সে সময় মটরসাইকেলকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন মনে করেছিল।সে আবিস্কার করলো মটরসাইকেল ছাড়া তার জীবন ব্যর্থা।এ ব্যর্থ জীবন রেখে আর কি লাভ!তাই সে এক সসময় আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।এমনি একদিন রাশেদ বিষ পানে আত্নহত্যার চেষ্টা চালায়।

কিন্তু প্রতিবেশিদের কারনে সে যাত্রায় বেচেঁযায় রাশেদ।এটা জানতে পেরে রফিক সাহেব সাথেসাথে বাড়ী ফিরে আসে।মনেমনে রাশেদের জীবনের জন্য অনেক মানতের সাথে তাকে মটরসাইকেল দেয়ারও মানত করে।বাড়ীতে এসে রফিক সাহেব ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যায়।সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাশেদের আশংঙ্কা মুক্তহয়ার কথা জানায়।কয়েকদিন পরেই রাশেদকে বাড়ী ফিরেনিয়ে আসা হয়।বাড়ীতে এসে সবাই যখন তার আত্নহত্যার কারন জানতে চায়,রাশেদ তখন আবালিল ভাবে বলেদেয়,সে মটরসাইকেলের জন্য আত্নহত্যা করতে চেয়েছিল,আর এটাও জানায় এর পরেও মটরসাইকেল নিয়ে না দিলে আবারও সে আত্নহত্যা করবে!


সেটা শুনার পর কোন পিতা কি ঠিক থকতে পারে?রফিক সহেবও ঠিক থাকতে পারেন নি,রাগে ক্ষোপে উপযুক্তপরি চড়-থাপ্প বসিয়ে দিল।পরের দিনেই তাকে মটরসাইকেল কিনে দেয়,সাথে সাথে শর্ত জুড়েদিল,এসএসসি পরিক্ষার আগে সে মটরসাইকেলে চড়তে পারবেনা।মটরসাইকেল শুধু ঘরের মধ্যে থাকবে।রাশেদ সে শর্তে রাজি হলো।রাশেদের ঘরের মধ্য মটরসাইকেলটি রাখা হলেও চাবি তার মা নিজের কাছে রেখেদেয়।

রফিক সাহেব আবার তার কর্মস্থলে ফিরে যায়।বাবার অনুপস্থিতিতে রাশেদ তার মাকে অনেক বুঝে কয়েও চাবি নিতে ব্যর্থ হয়।এমন কি ডুপ্লিকেট চাবি বানাতে গিয়েও ব্যর্থ হয় রাশেদ।এভাবে একের পর এক ব্যর্থ হয়ার পরেও রাশেদ সুযোগ খুজতে থাকে।এবার তার উদ্দেশ্য মায়ের কাছে থাকা চাবি চুরি করা,সে লক্ষে তার মা চাবি কোথায় রাখে নিশ্চিত হয়েছে।এবার সে সফলতার এক ধাপ এগিয়ে যায়।সে জানতে পারেছে আলমারিতে চাবি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।রাশেদ এবার সুযোগ খুজতে থাকে কি ভাবে তার মায়ের কাছে থাকা চাবি আলমারি থেকে হাতিয়ে নেয়া যায়।

তেমনি এক সকালে রাশেদের মা বড়ীর কিছু দূরে নিজেদের ফসলি জমি দেখতে গেছে।এমনি সময় রাশেদ তার মায়ের কাছে,স্কুলের শার্ট বের করার নামকরে আলমারির চাবি চায়।মটরসাইকেলের কথা সে সময় তার মায়ের মনেছিল না।তাই তিনি রাশেদকে চাবিটা দিয়ে বলে,খেয়েদেয়ে তারপর স্কুলে যাবি।রাশেদ হ্যাঁ সূচক মাথানেড়ে বাড়ীতে এসে ঝটপট আলমারি খুলে,মটরসাইকেলের চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পরে।কিছুক্ষন পরে তার মাও বাড়ীতে ফিরো দেখে রাশেদ মটরসাইকেল নিয়েগেছে!সে কথা রফিক সাহেবকে জানাতে গিয়েও আটকে যায় তার স্ত্রী।পাছে অনেক রাগারাগি করতে পারে এই ভেবে তাকে জানা হয়না।তাছাড়া রফিক সাহেব এই কথা কিছুতেই জানতে পারবে না, এটা ভাবতে থাকে রশেদের মা।এসব কিছু ভাবতে ভাবতে খবর আসে রাশেদ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে!ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্সে রাশেদ ঘটনা স্থলেই মারা যায়।


এ খবর রফিক সাহেবের কানে পৌচ্ছামাত্র সাথে সাথে বাড়ীর পথে রওনা দেয়।আসতে আসতে রফিক সাহেব ভাবতে থাকে,রাশেদ ছোট থাকতেই যদি আর একটু সচেতনতা অবলম্বন করাহত তাহলে আজ হয়তো এমনটা ঘটতনা।কোন কিছু চাওয়ার সাথে সাথে যদি রাশেদকে নিয়ে না দিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে তার পর ছেলের আবদার পূরন করতো,তাহলে কিছুটা হলেও রাশেদের মধ্যে সহনশিলতার সৃষ্টিহত,তখন হয়তো আর আজকে ছেলের মৃত্যুর খবর শুনতে হতোনা।



6 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
নবীনতর পূর্বতন